ছোট গল্প: ‘অবহেলা’
দৈনিক সিলেট ডট কম
-জুনায়েদুর রহমান
সিলেট রেলস্টেশনে অপেক্ষা করছি। এখন রাত সাড়ে আটটা। নয়টা চল্লিশ মিনিটের চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেসে দুটো টিকেট করেছি। একটা আমার জন্য অন্যটি পারুলের জন্য। পারুলের যেন এসে আমার জন্য অপেক্ষা করতে না হয় তাই আগেই চলে আসা। এখন একা বসে থাকতে ভালো লাগছে না। এদিকে পারুলকে ক্রমাগত কল দিয়েই যাচ্ছি, সে কল রিসিভ করছে না। হয়তো সে চট্টগ্রাম যাবার কথা ভুলেই গিয়েছে। পারুলের বেলায় বিষয়টি একেবারে সাধারণ। যেমন, সকালে কথা হলো তার সাথে বিকালে দেখা করবো, আমি এমসি কলেজে এসে তাকে কল দিচ্ছি। তার কোনো খোঁজ নেই। যখন সে কল রিসিভ করলো তখন মাগরিবের আজান হয়ে গেছে। পারুল তখন খুব সহজ ভঙ্গিতে বলবে, ‘ক্লাস করে এসে খুব ক্লান্তি লাগছিল। একটু শুয়েছি, কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেই পারি নি!’
এত খেয়ালী মানুষ হয়? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত পারুল আসবে না। অথচ আমাদের বিকেলে দেখা হয়েছে, কিছু কেনাকাটা ছিল। সে বলেছে, তার ব্যাগ গুছানো। শুধু মেসে গিয়ে গোসল করবে, এরপর বেরিয়ে পড়বে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাকে নিতে আসবো?’
‘এত দায়িত্ববান হতে হবে না। তুমি সোজা চলে যেও রেলস্টেশনে, আমাকে যথাসময়ে পাবে।’
পারুলের সাথে প্রেমের শুরুটা স্মরণ করার চেষ্টা করছি। কলেজের নবীন বরণের দিন আমি কলেজ গেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। আমার এক স্কুল ফ্রেন্ডের জন্য। হঠাৎ একটা মেয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই যে, অডিটোরিয়ামটি কোন দিকে?’ আমি দেখিয়ে দিলাম। সেই প্রথম দেখা। প্রথম দেখায় তাকে তেমন ভালো লাগেনি। একেবারে সাধারণ সালোয়ার কামিজ পরে এসেছিল, কোনো মেকাপ নেয় নি। তেমন সুন্দরীও বলা যায় না। এরকম মেয়েদের প্রথম দেখায় ভালো লাগে না। এরপর একসাথে ক্লাস, কোচিং করতে করতে কখন যে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেলো বুঝতেই পারিনি। কলেজ লাইফ এভাবেই কেটে গেলো। পড়ালেখায় সে ছিল অসম্ভব মেধাবী। আমাকে যেকোনো বিষয়ে সে সাহায্য করতো। আমার প্রেক্টিকাল খাতা করতে হবে, পারুল আছে নো প্্রব্লেম। মেয়েটার উদার মন মানসিকতা এবং আমাকে সাপোর্ট দেবার প্রবনতা তার সাথে ভালো একটা সম্পর্কের বীজ বুনেছিল। কলেজ লাইফ শেষ করে তার সাথে আমার আর আগের মতো দেখা হতো না। তখন থেকেই তাকে অনুভব করতে শুরু করলাম। আমার মনে হলো, আমাকে সবসময় সাপোর্ট দেওয়া এই সাধারণ মেয়েটিকে আমার প্রয়োজন। যেদিন তাকে প্রপোজ করলাম, সেদিন সেকি রাগ। আমাকে বলল, ‘এই ছিল তোর মনে? আমি তোকে কত ভালো বন্ধু ভাবতাম আর তুই কিনা আমাকে ভালোবাসিস বলছিস?’
যাইহোক একটা সময় তার মন গলাতে পারলাম। একদম পারফেক্ট প্রেমিক যুগল বলতে যা বুঝায় আমরা তাই হয়ে গেলাম। এর মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা বিয়ে করবো। আমি যেহেতু ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তাই আমার সময় ছিল অফুরন্ত। সে ছিল সাস্টের স্টুডেন্ট। সে একদম সময় বের করতে পারছিল না। ক্লাস, পরীক্ষা তার লেগেই আছে। এর মধ্যে তার ভার্সিটি কিছুদিন ছুটি হলো। তখন আমরা প্ল্যান করলাম, প্রথমে ট্রেনে চট্রগ্রাম চলে যাবো। আমাদের ইন্টারমিডিয়েটের অনেক বন্ধুবান্ধব তখন চট্টগ্রাম ছিল। সেখানে গিয়ে বন্ধুদের সহায়তায় বিয়ে করবো। এরপর সোজা চলে যাবো কক্সবাজার। সঙ্গে বিয়ের কাগজপত্র রাখবো। অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে দেখে কেউ যদি সন্দেহ করে আমরা স্বামী স্ত্রী কিনা তখন বিয়ের কাগজপত্র দেখাবো।
ট্রেন প্ল্যাটফর্মে চলে এসেছে। মাইকে বলা হচ্ছে ট্রেনে গিয়ে নির্দিষ্ট সিটে বসার জন্য। সবাই তাড়াহুড়ো করে ট্রেনে উঠছে। আমি বসে আছি। পারুল এখনো আসে নি। ভাবছি এখনই পারুল কল দিয়ে বলবে, ‘শেষ মুহুর্তে মনে হলো আমাদের এভাবে বিয়ে করাটা ঠিক হবে না। তুমি বাবা-মার কত আদরের সন্তান, নিশ্চয়ই আঙ্কেলের কত স্বপ্ন ছেলেকে নিজ হাতে পাগড়ি পরিয়ে বর সাজাবেন!’
কাল্পনিক কথোপকথন চলতে থাকল।
‘ভান করছো যেন আমার জন্য তোমার এত দরদ! আসলে তুমি আমার বাবা-মার কথা ভাবছো না। ভাবছো নিজের কথা।’
‘সেটা কি ভুল? আমার তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না৷ আরও ক’টা দিন পরেও তো বিয়ে করতে পারি।’
‘পারুল শুনো, এখন থেকে তোমার আর আমার পথ আলাদা।’
আমার ধারণা সত্যি হলো না। কারণ পারুল আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যি না হবারই কথা কারণ তার সাথে আমার এ রকম ঝগড়া কখনো হয়নি। তাকে বললাম, ‘আর কিছুক্ষণ লেট করলে ট্রেন মিস করতে।’
‘সিএনজি পাইনি। রিক্সা করে আসতে হয়েছে। তাই লেট হয়ে গেলো।’
‘তাই বলে কল রিসিভ করবে না? আমার কতটা টেনশন হচ্ছিল!’
‘এরকম টেনশন ভালোবাসা গাঢ় করে।’
ট্রেনে গিয়ে নির্দিষ্ট সিটে বসেছি। তার কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। পারুলকে খুব ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে কত সহস্র মাইল পাড়ি দিয়ে যেন সে এসেছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে? সব ঠিকঠাক তো?’
‘আবির, কাল আমার বিয়ে। বিয়ের কনেকে ঘিরে মেয়েরা বিয়ের দিন থাকে। অথচ আমার পাশে কেউ নেই।’
‘শুনো, যারা তোমাকে সেদিন ঘিরে থাকতো তারা কি সারাজীবন তোমার পাশে থাকবে? নিশ্চয়ই না। তোমার বিয়ের সময় আমি পাশে থাকবো, যে কিনা তোমার সারাজীবনের সঙ্গী।’
‘মন খারাপ না করতে বলছো?’
‘হুম। আচ্ছা, সব কিছু ম্যানেজ করে এসেছো তো?’
‘একদম। মেসে থাকায় এই সুবিধা হয়েছে, কোথায় যাচ্ছি, কি করছি এইসব কৈফিয়ত বাবা-মা কে দিতে হচ্ছে না।’
আমরা চট্টগ্রাম ঠিকমতো পৌঁছালাম। সেখানে বিয়ের কাজ সেরে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। সঙ্গে আমার বন্ধু অণির্বান। আমাদের বাসর হলো কক্সবাজারের একটা হোটেলে। এর আগে মাঝরাত অবধি সমুদ্রের তীরের বালুতে বসে গল্প করলাম। জীবন এত মধুর হতে পারে এর আগে কখনো এভাবে উপলব্ধি করিনি। গভীর রাতে যখন হোটেলে ফিরলাম তখন দেখি আমাদের রুম চমৎকার ভাবে সাজিয়ে রেখেছে অণির্বান। মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না।
সিলেটে ফিরে সেই আগের যান্ত্রিক জীবন শুরু হলো। সব কিছুর মধ্যেও আমরা সাস্ট, এমসি কলেজ, বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে প্রেমিক যুগলের মতোই ঘুরতে লাগলাম। জীবনে খুব একটা চেঞ্জ এলো না। মাঝেমধ্যে সে আমার মেসে আসতো। আমরা একান্তে সময় কাটাতাম। হাতে গুনা বন্ধুবান্ধব ছাড়া আমাদের বিয়ের বিষয়ে তেমন কেউ জানলো না।
এভাবেই সময় যাচ্ছিল। এর মধ্যেই একদিন সে জানালো, আমি নাকি বাবা হতে চলেছি!
আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তখন সবে অনার্স কমপ্লিট করেছি। একেবারেই বেকার। এখনো আমাদের বিয়ের ব্যাপারে ফ্যামিলি কিছু জানে না। কি করবো, কিছুই বুঝতে পারছি না। চিন্তা করলাম, উপায় একটাই- এবরশন। কিন্তু পারুলকে এই বিষয়টি বলি কিভাবে? একদিন তার সাথে দেখা করলাম। বললাম, ‘এই সন্তান আমরা রাখবো না। আমি বেকার। বিয়ের বিষয়ে ফ্যামিলি জানে না। এমতাবস্থায় সন্তান নেবো?’
পারুল সেদিন কিচ্ছু বললো না। শুধু তার চোখ টলমল করছিল। আমি ফিরে এলাম। এরপর এসব নিয়ে তার সাথে অনেক ঝামেলা হলো। সে এবরশন করতে রাজি না। প্রয়োজনে সে আমাকে ছেড়ে দিবে। সে তার সন্তানকে নিয়ে বাঁচবে।
এভাবে পারুল আমার সাথে যোগাযোগ একটা সময় বন্ধ করে দিলো। সিলেট শহর ছেড়ে চলে গেলো মৌলভীবাজার। তাদের ফ্যামিলি সেখানেই থাকতো। পারুলের হয়তো মনে হয়েছে, আমি তার সন্তানকে যেকোনো মূল্যে মেরে ফেলবো। সে তার ফ্যামিলির কাছে চলে যাবার পর কিভাবে পুরো বিষয়টি ম্যানেজ করেছে আমি তার কিছুই জানি না। অনেক চেষ্টা করেছি তার সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু সম্ভব হয়নি।
বছর খানেক পর একদিন সন্ধ্যাবেলা। জিন্দাবাজার থেকে কোর্ট পয়েন্ট হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি পারুল। সে রিক্সায় যাচ্ছে। কোলে ফুটফুটে একটা মেয়ে। মেয়েটার কপালে ছোট্ট টিপ, গায়ে লাল জামা। এমন পরিস্থিতিতে আমার কি করা উচিত ভাবতে ভাবতেই রিক্সা দ্রুত চোখের আড়াল হয়ে গেলো। আমি পারুল বলে ডাকতে চেয়েও ডাকতে পারলাম না। তখন আমার কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আমিতো এই নিষ্পাপ মেয়েটির বাবা না। আমি তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম, আমি খুনী।
তখন আমি নিজেকে হয়তো আড়াল করার জন্য দাঁড়ি রেখেছি। অনেক দিন পর হঠাৎ কেউ দেখলে আমাকে চেনার কথা না। তবু নিশ্চিত একদিন আমার পারুলের সাথে সামনাসামনি দেখা হবে। সে আমাকে দেখে এক পলকেই চিনে ফেলবে। সেই দিন আসতে খুব বেশি দেরি হলো না৷ একদিন সে আমাকে দেখে না দেখার ভান করলো। আমি কাছে গিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম, ‘কেমন আছো পারুল? আমি তোমার কত খোঁজ করেছি।’
পারুলের খুব একটা ভাবান্তর লক্ষ্য করলাম না। যেন আমি কেউ না। আমার কথার কোনো জবাবও সে দিলো না। তার কাঁধে বাচ্চা মেয়েটি ঘুমিয়ে ছিল। সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেলো।
আমি এটা সহ্য করতে পারলাম না। ইচ্ছে করল তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে।
পারুলের সমন্ত ভালোবাসা তার মেয়েকে ঘিরে। সেখানে আমার স্থান নেই। এই অবহেলা আমার প্রাপ্য।