ভারতে নিষিদ্ধ পিএফআইর জেএমবি সংশ্লেষ কতটুকু?
দৈনিক সিলেট ডট কম
দৈনিকসিলেটডেস্ক: ভারত সম্প্রতি পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া (পিএফআই) নামে একটি মুসলিম সংগঠন নিষিদ্ধ করার পেছনে সরকার যেসব যুক্তি দেখিয়েছে তার অন্যতম হলো বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি বা জামায়েতুল মুজাহিদিনের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও যোগসাজশ।
জেএমবি শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতেও ২০১৯ সালে তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর থেকে বাংলাদেশে জেএমবির কর্মকাণ্ডের কথা খুব একটা শোনা যায় না। তারপরও সেই জেএমবির সঙ্গে পপুলার ফ্রন্টের কী সম্পর্ক, তা যথারীতি প্রশ্ন উঠেছে।
ভারতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ তদন্ত সংস্থা এনআইএ (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি) এ ব্যাপারে একটি বিস্তারিত দলিল তৈরি করেছে। সেই দলিলেই এই দুই সংগঠনের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়টি বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশে জেএমবি নিষিদ্ধ হওয়ার পর এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা শুরু হতেই সংগঠনের বহু সদস্য পালিয়ে প্রতিবেশী ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড এমনকি সুদূর কর্ণাটকের মুসলিম-প্রধান এলাকাগুলোতে আশ্রয় নেয়।
ভারতে জেএমবি সদস্যরা ধীরে ধীরে ‘জামায়েতুল মুজাহিদিন হিন্দুস্তান’ গড়ার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। তবে সেসব করা হতে থাকে একেবারেই ‘নীরবে’। এই পর্যায়ে তাদের প্রধান কাজ ছিল দুটো —তহবিল সংগ্রহ আর মুসলিম সমাজের মধ্যে থেকে ‘ভালনারেবল’ তরুণদের বেছে নিয়ে রিক্রুট করা। এ কাজের জন্য তারা স্থানীয় মাদ্রাসা ও মসজিদ এবং সোশাল মিডিয়াকে বেছে নেয়।
এনআইএ’র দলিল আরও বলছে, ভারতীয় রিক্রুটদের অস্ত্রশস্ত্রে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজও চলতে থাকে পাশাপাশি। যেখানে সুযোগ ছিল, সেখানে ক্যাডারদের বোমা বানানো শেখানো হয়। আর যেখানে সুযোগ ছিল না, সেখানে তীর-ধনুকের মতো দেশি অস্ত্র বানিয়ে কীভাবে শত্রুর মোকাবিলা করা যাবে, তারও ট্রেনিং দেওয়া হতে থাকে। ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত এলাকায় এরকম বেশ কিছু ‘শিবিরেরও’ সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানানো হচ্ছে।
২০১৪ সালের অক্টোবরে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে খাগড়াগড় বিস্ফোরণকাণ্ডে জেএমবির জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে আসার পরই পশ্চিমবঙ্গ ও আসামজুড়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু হয় এবং ৫০ জনেরও বেশি জেএমবি সদস্যকে আটক করা হয়। এছাড়া আবিষ্কৃত হয় জেএমবির বোমা বানানোর অনেক ‘কারখানা’, সেখান থেকে শতাধিক শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করা হয়।
এনআইএর তথ্য অনুসারে, ঠিক এই পর্যায়েই পিএফআইর সঙ্গে জেএমবির ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত। পিএফআই যদিও আরও অনেক আগেই (২০০৬) কেরালার তিনটি মুসলিম সংগঠন একত্রিত হয়ে গঠিত হয়েছিল। তারও প্রায় বছর দশেক পরে ধীরে ধীরে ভারতজুড়ে তাদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়ে। জেএমবির বহু সদস্য ও ক্যাডার তখন গ্রেফতার থেকে বাঁচতে পিএফআই-এর সদস্য হয়ে যায় বা তাদের ছাতার তলায় আশ্রয় নেয়।
পিএফআই নিজেদের মূলত একটি সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন বলেই পরিচয় দেয়, যারা ভারতীয় মুসলিমদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্দোলন করে থাকে। পাশাপাশি তারা করতো সমাজসেবার কাজও, সাবেক জেএমবি সদস্যরা ধীরে ধীরে তাতেও জড়িয়ে পড়ে। এনআইএর দলিল জানাচ্ছে, এমনকি চলতি বছর আসামের বিধ্বংসী বন্যায় পিএফআই যে ব্যাপক ত্রাণ অভিযান চালিয়েছিল, তাতে রাজ্যের বাংলাভাষী এলাকাগুলোতে তাদের বহু ত্রাণকর্মীই ছিল জেএমবির সাবেক সদস্য।
পিএফআই ও জেএমবির মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক ছিল, তার নিদর্শন হিসেবে এই ধরনের নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে ভারতের এনআইএ। এমনকি তারা এই দাবিও করছে যে, জেএমবির মাধ্যমে পিএফআইয়ের সঙ্গে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বারও সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কারণ, বাংলাদেশের জেএমবির সঙ্গে পাকিস্তানের লস্করের বহু বছর আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল।
গত মাসেই মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের একটি বিশেষ আদালতে এনআইএ ৬ জন সন্দেহভাজন জঙ্গির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে। যাদের সবাইকে তারা জেএমবি সদস্য হিসেবে বর্ণনা করেছে। চার্জশিটে বলা হয়েছে, ভারতে তারা নাশকতা চালানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
এই ৬ জনের মধ্যে তিনজনকে (ফজল আলী, ওয়ালিউল্লাহ মিলন, জয়নাল আবেদীন) তারা বাংলাদেশ থেকে আসা জেএমবি সদস্য এবং বাকি তিন জনকে ভারতের জেএমবি সদস্য বলে পরিচয় দিয়েছে। এই ভারতীয়দের মধ্যে একজন বিহারের কাটিহার জেলার ও দুজন মধ্যপ্রদেশের বিদিশা জেলার বাসিন্দা।
ফলে ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার প্রায় বছর চারেক পরেও জেএমবি যে অবলুপ্ত হয়নি, এনআইএর চার্জশিটেই সে কথা কার্যত মেনে নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, পিএফআইর সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা যে নিজেদের ক্রমশ শক্তিশালী করে তুলছিল, পপুলার ফ্রন্টকে নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে সেটাও স্বীকার করে নিয়েছে ভারত।