বাড়িঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় মুমিনের লক্ষণীয়
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
বসবাসের প্রয়োজনে ঘর-বাড়ি তৈরি করতে হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ইসলামের আলোকে মুমিনের কিছু লক্ষণীয় বিষয় আছে। নিম্নে সে বিষয়ে আলোচনা করা হলো—
স্থান নির্বাচন : ঘর মহান আল্লাহর অন্যতম নিয়ামত। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আর আল্লাহ তোমাদের ঘরগুলোকে তোমাদের জন্য আবাস করেছেন। (সুরা নাহাল, আয়াত : ৮০)
বাড়ি করার ক্ষেত্রে উপযুক্ত স্থান নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই বাড়ি তৈরির জন্য জায়গা নির্বাচনের সময় সেখানকার নিরাপত্তাব্যবস্থা, যাতায়াতব্যবস্থা, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি বিবেচনা করা জরুরি। যতটুকু সম্ভব বাড়িকে পরিবেশবান্ধব ও প্রশস্ত করার চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি বাড়ি করার সময় পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখাও জরুরি বিষয়। যেমন—অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা, পয়োনিষ্কান ব্যবস্থা ইত্যাদিও বিবেচনায় রাখতে হবে। যা রাষ্ট্রীয় বিল্ডিং কোড মানার মাধ্যমে সম্ভব। বাড়ি করার সময় বিল্ডিং কোড মানা বা নিরাপত্তা ও প্রশস্ততার বিষয়টি মাথায় না রাখলে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। বাড়ির আঙিনায় এবং প্রয়োজনীয় খালি জায়গা না থাকলে ফায়ার সার্ভিস কিংবা উদ্ধারকর্মীরাও দুর্ঘটনার সময় ঠিকভাবে কাজ করতে পারেন না। হয়তো এ জন্যই নবীজি (সা.) প্রশস্ত বাড়িকে সৌভাগ্যের নিদর্শন বলেছেন।
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, নাফে ইবনে আবদুল হারিস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির সৌভাগ্যের নিদর্শন হলো প্রশস্ত বসতবাড়ি, উত্তম প্রতিবেশী এবং মনঃপূত বা আরামদায়ক বাহন।’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৫৯)
প্রতিবেশী কারা হবে, তা বিবেচনায় রাখা : হাদিসে বলা হয়েছে সৎ প্রতিবেশী সৌভাগ্যের লক্ষণ। ইসলাম প্রতিবেশীকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছে যে সাহাবায়ে কেরামের ধারণা হয়েছিল সম্ভবত প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেওয়া হবে। মুজাহিদ (রহ.) থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.)-এর জন্য তাঁর পরিবারে একটি ছাগল জবেহ করা হলো। তিনি এসে বলেন, তোমরা কি আমাদের ইহুদি প্রতিবেশীকে (গোশত) উপহার পাঠিয়েছ? আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, প্রতিবেশীর অধিকার প্রসঙ্গে জিবরাইল (আ.) আমাকে অবিরত উপদেশ দিতে থাকেন। এমনকি আমার ধারণা হলো যে হয়তো শিগগিরই প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৫২)
তাই বাড়ি করার সময় সেখানকার প্রতিবেশীরা হবে তাও বিবেচনা করা ভালো। প্রতিবেশী ভালো না হলে সেখানে বসবাস করা কঠিন হয়ে যায়।
প্রশস্ত রাস্তা রাখা : বাড়ি করার সময় সেখানকার যাতায়াতব্যবস্থা বিবেচনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নইলে হঠাৎ অসুস্থতাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যানবাহনের সংকটে পড়তে হয়। এ জন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) বাড়ির রাস্তার একটি আদর্শ মাপ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, যখন মালিকরা রাস্তার ব্যাপারে পরস্পরে বিবাদ করল, তখন নবী (সা.) রাস্তার জন্য সাত হাত জমি ছেড়ে দেওয়ার ফয়সালা দেন। (বুখারি, হাদিস : ২৪৭৩)
ওই হাদিসে রাসুল (সা.) একটি আধুনিক রাস্তার সর্বনিম্ন প্রস্থ সাত হাত নির্ধারণ করেছেন, যা ফুটের হিসাবে চিন্তা করলে ১০ ফুট ৬ ইঞ্চি হয়। বর্তমান যুগে একটি গ্রামীণ রাস্তার সর্বনিম্ন প্রস্থ ১০ ফুট পাকা হিসাব করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের এলজিইডি বিভাগের ‘রোড ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ডস ২০০৪’-এর ৬.১ ধারা অনুযায়ী ইউনিয়ন সড়কগুলো সর্বনিম্ন ৩ মিটার বা ১০ ফুট প্রশস্ত হয়। ১০ ফুট পিচ ঢালাইয়ের দুই পাশে আবার ৩ ইঞ্চি করে মোট ৬ ইঞ্চি ইটের এইজিং দেওয়া হয়, যা রাস্তার পাকা অংশের সঙ্গে হিসাব করলে ১০ ফুট ৬ ইঞ্জিই দাঁড়ায়।
গাছগাছালি রাখা : গাছ আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। পর্যাপ্ত অক্সিজেনের জন্য বাড়ির আঙিনায় গাছগাছালি রাখা আবশ্যক। শহুরে বাড়ির ক্ষেত্রে বারান্দা ও ছাদেও গাছের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। এতে যেমন ঘরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন সরবরাহ হবে, তেমনি এর ফল-ফলাদি থেকে পাখি ইত্যাদি কিছু খেলেও সদকার সওয়াব পাওয়া যাবে।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলিম কোনো গাছ রোপণ করে অথবা ক্ষেতে ফসল বোনে, আর তা থেকে কোনো বিহঙ্গ কিংবা মানুষ বা চতুষ্পদ প্রাণী খায়, তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩২০)
শিশুদের খেলার আঙিনা রাখা : শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা প্রয়োজন। তাই বাড়ি করার ক্ষেত্রে শিশুদের খেলাধুলার পরিবেশ রাখা জরুরি। হাসান ও হোসাইন (রা.)-ও খেলাধুলা করতেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৪৪)
ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, শিশু যখন মক্তব (বিদ্যালয়) থেকে ফিরে আসে, তখন তাকে খেলাধুলার সুযোগ দেওয়া উচিত। যাতে দীর্ঘ সময়ের পড়াশোনার চাপ দূর হয়ে যায়। শিশুকে যদি খেলাধুলার সুযোগ না দেওয়া হয় এবং সারাক্ষণ বই-খাতা নিয়ে বসে থাকতে বাধ্য করা হয়, তাহলে তার স্বতঃস্ফূর্ততা বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। পড়াশোনা তার কাছে কারাগারের শাস্তি বলে মনে হবে। ফলে সে যেকোনোভাবে এই বন্দিদশা থেকে মুক্তির জন্য অস্থির হয়ে উঠবে। (ইহয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/৫৯)
পর্দার ব্যবস্থা রাখা : বাড়ি করার ক্ষেত্রে পারিবারিক গোপনীয় বজায় রাখার বিষয়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের অবহেলার কারণে শহুরে বাসাগুলোতে মানুষের পারিবারিক গোপনীয় ক্ষুণ্ন হয়। যা মারাত্মক অপরাধ।
আব্দুর রহমান ইবনু সাদ (রহ.) বলেন, আমি আবু সাঈদ আল-খুদরি (রা.)-কে বলতে শুনেছি, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় আমানত হবে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর যৌন সম্ভোগ সম্পর্কিত বিষয়। যে গোপনীয় বিষয় স্বামী প্রকাশ করে দিল। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৭০)
তাই বাড়ি করার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারটিও মাথায় রাখা উচিত। বাড়ির ডিজাইন এমনভাবে করা উচিত, যাতে বাড়িতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসও থাকে, আবার ঘরনীদের পর্দাও রক্ষা হয়।
ঘরে ইবাদতের পরিবেশ রাখা : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের ঘরকে কবর সদৃশ করে রেখো না (অর্থাৎ নফল নামাজগুলো বাড়িতে আদায় করবে। কারণ যে ঘরে সুরা বাকারা পাঠ করা হয় শয়তান সে ঘর থেকে পালিয়ে যায়)। (মুসলিম, হাদিস : ১৭০৯)