স্কটিশ যুদ্ধবন্দি যখন মদিনার গভর্নর ছিলেন
মো. আবদুল মজিদ মোল্লা
পবিত্র নগরী মদিনার গোড়াপত্তনের পর বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি এর প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে ব্রিটিশ নাগরিক থমাস কেইথ তাঁদের ব্যতিক্রম। কেননা তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠার কোনোটিই মুসলিম পরিবারে হয়নি। এমনকি তিনি কোনো মুসলিম দেশেরও নাগরিক ছিলেন না।
তিনি ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে থমাস কেইথ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ৭৮তম হাইল্যান্ডারস রেজিমেন্টে যোগদান করেন। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ব্রিটিশ উপনিবেশ সিসিলিতে পাঠানো হয়।
কেইথ ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে মিসরের আলেক্সেন্দ্রিয়া নগরী দখলে ব্রিটিশ অভিযানে অংশ নেন।
কিন্তু এই অভিযান ব্যর্থ হয় এবং ব্রিটিশ ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়। বহু সৈনিক নিহত হয় এবং অনেকেই গ্রেপ্তার হয়। ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল থমাস ও তাঁর রেজিমেন্টের বাদ্যবাজক উইলিয়াম থম্পসন রোসেটা দ্বীপের নিকটবর্তী আল হামিদ এলাকা থেকে আটক হন। তাদের আরো ৪৫০ জন ব্রিটিশ বন্দির সঙ্গে কায়রোতে পাঠানো হয়।
একজন আলবেনীয় বর্শাচালক তাদের সামরিক ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেন। উসমানীয় অফিসার আহমদ বোনাপার্ট তাঁদের দুজনকে কিনে নেন। থমাস কেইথ আহমদের সেবা করে তাঁর প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। আহমদের আচরণ ও মুসলমানদের রীতিনীতি দেখে দুই স্কটিশ সৈনিক ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। ইসলাম গ্রহণের পর কেইথ ইবরাহিম এবং থম্পসন উসমান নাম ধারণ করেন।
আহমদের কাছ থেকে থমাস কেইথকে মিসরের তৎকালীন উসমানীয় গভর্নর মুহাম্মদ আলী পাশার স্ত্রী আমিনা হানিম কিনে নেন। তিনি তাঁকে তাঁর ছেলে তুসুনের সেবায় নিয়োজিত করেন। তুসুন স্কটিশ থমাসের সামরিক ও আরবি ভাষার দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হন। পরবর্তী সময়ে থমাস কেইথ তুসুনের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তুসুন থমাসের মৃত্যুদণ্ড দেন। কিন্তু প্রহরীদের হত্যা করে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি তুসুনের মায়ের কাছে ক্ষমা ও আশ্রয় প্রার্থনা করেন। আমিনা হানিম তাঁকে ক্ষমা করেন এবং তুসুনের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে এগিয়ে আসেন। কেননা তিনি থমাসের উচ্চতর সামরিক দক্ষতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। প্রহরীদের হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে থমাসের বীরত্বের কথা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মানুষ তাঁকে ‘আগা’ উপাধি দেয়। পরবর্তী সময়ে তিনি আগা ইবরাহিম নামেই পরিচিতি লাভ করেন।
১৮১১ খ্রিস্টাব্দে ১৮ বছর বয়সী আগা ইবরাহিম এবং ১৭ বছর বয়সী তুসুন ‘আলে সৌদ’ তথা সৌদি রাজপরিবারের নেতৃত্বাধীন ওয়াহাবি বিদ্রোহের বিরুদ্ধে এক অভিযানে যোগদান করেন। এই অভিযানে দুই হাজার আলবেনীয় ও বেদুইন সেনা ছিল। ইবরাহিম আগা ছিলেন এই বাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক ব্যক্তিত্ব (সেকেন্ড ইন কমান্ড)। ১৮১২ সালে আলে সৌদের বিরুদ্ধে আগা ইবরাহিমের বাহিনী বড় ধরনের সাফল্য লাভ করে। পবিত্র মদিনা নগরী উদ্ধারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৮১৫ সালে উসমানীয় শাসকদের পক্ষ থেকে তাঁকে মদিনার ভারপ্রাপ্ত গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে মক্কা নগরী উদ্ধারেও আগা ইবরাহিম সাহসিকতার পরিচয় দেন এবং মক্কার নিকটবর্তী বিদ্রোহী সেনা ছাউনিগুলো গুঁড়িয়ে দেন। এ বছরই একজন ওয়াহাবি উগ্রবাদীর হাতে তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন। ১৮১৮ সালে উসমানীয়দের হাতে বন্দি সৌদি রাজপুত্র আবদুল্লাহ বিন সৌদ তাঁর বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
সূত্র : মিডিয়াম ডটকম, রোজে এজাল্ট ডটকম ও উইকিপিডিয়া