সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা: গোয়াইনঘাট
![](https://dainiksylhet.com/files/uploads/2024/06/fl.jpg)
ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সিলেট অঞ্চল বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় অঞ্চল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, জনগণের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, প্রাকৃতিক সম্পদের (গ্যাস, চুনাপাথর, পাথর, বালু) প্রাচুর্যতা, প্রাকৃতিক তেলের সন্ধান প্রাপ্তি, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে থেকে সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীগণে প্রেরিত প্রচুর পরিমান রেমিটেন্স, টিলাময় এলাকা এবং যথেষ্ঠ পরিমাণ পতিত জমি এ অঞ্চলের বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। ইতিপূর্বে সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির উদ্যোগে পরিচালিত “সিলেট অঞ্চলে প্রবাসী বিনিয়োগ: একটি সামগ্রিক পর্যালোচনা” নাম গবেষনাধর্মী কাজের সাথে গবেষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো। ক্ষুদ্র আঞ্চলিক বাজার, কাঁচামাল আনয়নে অধিক পরিবহন ব্যয়, বিপুল পরিমান নীচু এলাকায় দুরূহ যোগাযোগ ব্যবস্থা, অদক্ষ জনশক্তি, জমিসংক্রান্ত সমস্যা, প্রারম্ভিক মূলধনের অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ইত্যাদিকে সিলেট অঞ্চলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রধান কয়েকটি প্রতিবন্ধকত হিসেবে বিবেচনা করা যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, ব্যবসা বান্ধব নীতিমালা প্রনয়ন ইত্যাদি এ অঞ্চলে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। সিলেট অঞ্চলের সম্ভাব্য বিনিয়োগরে খাতগুলো হলো আগর-আতর শিল্প, সিরামিক শিল্প, রাবার শিল্প, কৃষিজাত শিল্প, পর্যটন শিল্প, তথ্য-প্রযুক্তি খাত, বেত শিল্প, স্বাস্থ্য সেবা খাত, শিক্ষা খাত, ব্যাটারী ও টায়ার উৎপাদন, কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপদন, ইট উৎপাদন, প্লাস্টিক শিল্প, ফুড প্রসেসিং ইন্ডাষ্ট্রি, ক্যাবল ইন্ডাষ্ট্রি, ফিশ প্রসেসিং ইন্ডাষ্ট্রি, জৈবসার কারখানা, গবাদিপশুজাত শিল্প, চারকোল উৎপাদন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, চামরা প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, গ্লাস উৎপাদন, বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট ইত্যাদি। বর্তমানে নতুনভাবে সিলেট জেলার ১৩টি উপজেলার বিনিয়োগ সম্ভাবনা ও বিনিয়োগের সম্ভাব্য খাত সনাক্ত করার চেষ্টা করেছি।
৪৮১.১৩ বর্গ কি:মি: জুড়ে অবস্থিত গোয়াইনঘাট উপজেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয়, দক্ষিণে সিলেট সদর উপজেলা ও জৈন্তাপুর উপজেলা, পূর্বে জৈন্তাপুর উপজেলা ও পশ্চিমে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা রয়েছে। উপজেলার প্রধান নদী সারি নদী, গোয়াইন নদী এবং পিয়াইন নদী। গোয়াইনঘাটে ইউনিয়নের সংখ্যা ১২ টি এবং গ্রামের সংখ্যা ২৬৪টি। গোয়াইনঘাটের জনসংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ৫০১ জন। গড় শিক্ষার হার ৩২.৭%। গোয়াইনঘাটে ১১৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৫টি কলেজ এবং ৯টি মাদ্রাসা রয়েছে। পাথর ব্যবসা, কয়লা ব্যবসা, চুনাপাথর ব্যবসা, চা উৎপাদন এবং পান উৎপাদন গোয়াইনঘাটের অন্যতম ব্যবসা। এখানে জাফলং, ফতেহপুর এবং গুলনী নামক ৩টি চা বাগান রয়েছে। জাফলং, বিছানাকান্দি, রাতারগুল, পান্তুমাই ইত্যাদি গোয়াইনঘাটের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। বেশ কয়েকটি খাসিয়া পুঞ্জি রয়েছে। এ সকল স্পটকে সামনে রেখে পর্যটনখাতে প্রচুর বিনিয়োগ হতে পারে এবং হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট গড়ে উঠতে পারে। ইতিমধ্যে জাফলং এর জিরো পয়েন্টে হোটেল জাফলং পয়েন্ট নামক একটি হোটেল গড়ে উঠেছে। গোয়াইনঘাটের স্থলবন্দর দিয়ে প্রচুর পরিমান কয়লা এবং পাথর আমদানী হয় এবং দেশের বিভিন্নস্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে। গোয়াইনঘাটের বিভিন্ন ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি ডেইরী ফার্ম রয়েছে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে এ খাতে আরও বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। এ উপজেলার অনেক জায়গা অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে এবং স্বল্পমূল্যে জমি ক্রয় করা সম্ভব। এখানে প্রচুর পরিমান প্রাকৃতিক ঘাস রয়েছে এবং আরও ঘাস উৎপন্ন করা সম্ভব। গোয়াইনঘাটের বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর পরিমান শাক-সবজি উৎপাদিত হয়। জাফলং-এ প্রচুর পরিমাণ টমেটো, মূলা, আলু, শীম ইত্যাদি উৎপাদিত হয়। হিমাগার করা সম্ভব হলে প্রচুর পরিমাণ শাক-সবজি দেশ এবং বিদেশ সরবরাহ করা সম্ভব হবে। গোয়াইঘাটে অব্যবহৃত টিলা এবং উচুস্থান থাকার ফলে আরও চা বাগান তৈরীর মাধ্যমে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। এছাড়াও পান ও সুপারির উৎপাদন বৃদ্ধি করাও সম্ভব। বর্তমানে গোয়াইনঘাটে পাথর কোয়ারীগুলো বন্ধ রয়েছে। এগুলো চালু হলে পাথর আহরণ বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে প্রায় ৫ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং প্রবাসীগণ, ক্রাশার মিল মালিকগণ এবং ট্রাক মালিকগণ লাভবান হবেন। ক্রাশার মিলগুলোতে প্রচুর বিদ্যুৎ প্রয়োজন। গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর, লেংগুরাসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে নি¤œ অঞ্চল ও বিল-হাওড় রয়েছে। এলাকায় মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং মৎস্য খামারের সংখ্যা বৃদ্ধি করা সম্ভব। গোয়াইনঘাটে ফিশ প্রসেসিং প্ল্যান্ট তৈরী করা সম্ভব হলে দেশে এবং বিদেশে মাছের সরবরাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। গোয়াইনঘাট উপজেলার আলীরগাঁও ইউনিয়নের যোগাযোগ ভালো হবার ফলে এবং প্রচুর পরিমান খালি জমি থাকার ফলে এখানে সোলার প্ল্যান্ট করা যেতে পারে। গ্যাস সংযোগ পাওয়া সাপেক্ষে পাওয়ার প্ল্যান্ট করার বিষয়টি পর্যালোচনা করা যেতে পারে। আলীরগাঁও ইউনিয়ন, লেংগুরা ইউনিয়ন এবং বিশেষত ফতেহপুর ইউনিয়নে রয়েছে অসংখ্য আনারসের বাগান এবং এলাকায় আনারসের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব। অব্যবহৃত অসংখ্য টিলা ও উচুস্থানে আনারস, ড্রাগন ফল ও চা উৎপাদন করা যেতে পারে। এছাড়াও রাবার বাগানের মাধ্যমে রাবার উৎপাদন সম্ভব। দেশী মাল্টা, কমলা, লেবু, পান ও সুপারীর উৎপাদন প্রচুর পরিমানে বৃদ্ধি করা সম্ভব। গোইয়ানঘাটের রুস্তমপুর ইউনিয়ন ও তোয়াকুল ইউনিয়নে বেত উৎপন্ন হয়। গোয়াইনঘাটে বেত নির্মিত দ্রব্যাদি উৎপাদন করা সম্ভব। হাস-মুরগীর খামার বৃদ্ধি করা গোয়াইনঘাটের প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই সম্ভব। গোয়াইনঘাট উপজেলার অনেকেই আর্থিক অবস্থা উন্নতির সাথে সাথে নি¤œ এলাকা ছেড়ে সিলেট শহরের দিকে চলে আসেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত গোয়াইঘাট এলাকার মানুষে আচরণ বন্ধুত্বসূলভ এবং এখানকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ ভালো। জাফলং এলাকার শিক্ষার হার অন্যান্য ইউনিয়নের তুললায় ভালো। বিদ্যুতের স্বল্পতা, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং দারিদ্রতা গোয়াইনঘাটের অন্যতম সমস্যা। গোইয়ানঘাটের প্রবাসীগণের মধ্যে ৯৫% জনগন সৌদিআরব, ওমান, কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব-আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে থাকেন। প্রায় ৫% জনগন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, আমেরিকা, কানাডাসহ অন্যান্য দেশে অবস্থান করছেন। গ্যাস সংযোগ, পর্যাপ্ত বিদ্যুতের সরবরাহ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে গোয়াইঘাটের বিনিয়োগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধী বৃদ্ধি পাবে।
সম্ভাব্য বিনিয়োগের খাত/সম্ভাব্য উৎপাদনঃ
[পর্যটন খাত, মৎস্য খাত ও ফিশ প্রসেসিং প্ল্যান্ট, সোলার অথবা পাওয়ার প্ল্যান্ট, ডেইরী ফার্ম, হাঁস-মুরগীর খামার, আনারস, ড্রাগন ফল, লেবু, চা, পান, সুপারির উৎপাদন বৃদ্ধি, শাক-সবজির উৎপাদন ও হিমাগার নির্মান। ক্ষেত্র বিশেষে ফিজিবিলিটি টেস্ট প্রয়োজন।]
–চলবে
ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল
অধ্যাপক,ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ,শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়