মুসলিম সমাজের বিরোধ নিরসনে করণীয়
মো. আবদুল মজিদ মোল্লা
মুসলমান পরস্পরের ভাই। সুতরাং তারা পারস্পরিক সংঘাত পরিহার করবে। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে এবং অসংখ্য হাদিসে মুমিনদের বিবাদ-সংঘাত পরিহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বিশেষত দ্বিনি বিষয়ে বিরোধ ও সংঘাত অত্যন্ত অপছন্দনীয় বিষয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা দ্বিন সম্পর্কে নানা মতের সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোনো দায়িত্ব তোমার নয়; তাদের বিষয় আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন।’
(সুরা : আনআম, আয়াত : ১৫৯)
বিরোধ-বিশৃঙ্খলা পরিহার করা আবশ্যক
মুসলমানের জন্য বিরোধ-বিশৃঙ্খলাকে ভয় করা এবং তা থেকে আত্মরক্ষা করা আবশ্যক। কেননা তার কুফল সবাইকেই ভোগ করতে হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা এমন ফিতনাকে ভয় করো, যা বিশেষ করে তোমাদের মধ্যে যারা জালিম কেবল তাদেরকেই ক্লিষ্ট করবে না এবং জেনে রাখো যে নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ২৫)
আল্লামা ইবনে আশুর (রহ.) বলেন, ফিতনার অর্থ হলো মতানৈক্য, চারিত্রিক স্খলন এবং মানুষের মনে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া। (আততাহরির ওয়াত তানভির : ৯/৩১২)
বিরোধ বাড়ায় এমন কাজও নিষিদ্ধ
ইসলাম মুসলমানের জন্য এমন কাজগুলোও নিষিদ্ধ করেছে, যা পারস্পরিক বিরোধ সৃষ্টি করে বা তা বাড়িয়ে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা অনুমান থেকে বেঁচে চলো। কেননা অনুমান বড় মিথ্যা ব্যাপার। আর কারো দোষ খুঁজে বেড়িও না, গোয়েন্দাগিরি কোরো না, পরস্পরকে ধোঁকা দিয়ো না, আর পরস্পরকে হিংসা কোরো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ কোরো না এবং পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ কোরো না, বরং সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৬৬)
ভ্রাতৃসংঘাতের যত ক্ষতি
কোরআন-হাদিসের আলোকে ভ্রাতৃসংঘাতের কয়েকটি ক্ষতিকর দিক হলো—
১. বিরোধ আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করে : মুসলমানরা বিরোধে লিপ্ত হলে আল্লাহর অনুগ্রহ উঠে যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন, যখন তোমরা আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদেরকে বিনাশ করছিলে, যে পর্যন্ত না তোমরা সাহস হারালে এবং নির্দেশ সম্পর্কে মতভেদ করলে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫২)
২. বিরোধ শক্তি ক্ষয় করে : পারস্পরিক বিরোধ মুসলিম উম্মাহর শক্তিকে ক্ষয় করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, করলে তোমরা সাহস হারাবে, তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৪৬)
৩. মতবিরোধ ভ্রষ্টদের কাজ : দ্বিনি বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হওয়া ভ্রষ্ট মানুষের কাজ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা তাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শন আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৫)
৪. বিভক্তি আল্লাহর অবাধ্যতার শামিল : আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, বিভক্ত হতে নিষেধ করেছেন। তাই বিভক্তি আল্লাহর অবাধ্যতার শামিল। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০২)
সংঘাতের প্রধান দুই কারণ
মূলত মুসলমানের ভেতর দুই কারণে সংঘাত হয়। তাহলো—
১. পার্থিব মোহ সংঘাতের কারণ : মূলত পার্থিব মোহই মানুষকে সত্যমুখী হতে দেয় না। ফলে পারস্পরিক সংঘাতে লিপ্ত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যা তোমরা ভালোবাসো তা তোমাদের দেখানোর পর তোমরা অবাধ্য হলে। তোমাদের কতক ইহকাল চাচ্ছিল এবং কতক পরকাল চাচ্ছিল।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫২)
২. নিজের মতকে চূড়ান্ত মনে করা : নিজের মতকে চূড়ান্ত মনে করা যেকোনো বিষয়ে বিরোধের অন্যতম কারণ। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমাদের এই যে জাতি তা তো একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক; অতএব, আমাকে ভয় করো। কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দ্বিনকে বহুধা বিভক্ত করেছে। প্রত্যেক দলই তাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত।’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৫২-৫৩)
মুসলমানের বিরোধ মিটিয়ে ফেলা আবশ্যক
মুমিনের পরস্পরের মধ্যে কোনো বিষয়ে বিরোধ-বিভক্তি দেখা দিলে তা মিটিয়ে ফেলা আবশ্যক। ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই; সুতরাং তোমরা ভাইদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করো আর আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১০)
বিরোধ মীমাংসায় করণীয়
বিরোধ মীমাংসায় মুমিনের করণীয় হলো—
১. বিশুদ্ধ নিয়তে চেষ্টা করা : কোনো সমস্যার সমাধানে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় নিরপেক্ষভাবে তা করা আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের বেশির ভাগ গোপন পরামর্শে কোনো কল্যাণ নেই, তবে কল্যাণ আছে যে নির্দেশ দেয় দান-খয়রাত, সৎ কাজ ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের; আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আকাঙ্ক্ষায় কেউ তা করলে তাকে অবশ্যই আমি মহাপুরস্কার দেব।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ১১৪)
২. আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পথই সমাধান : যেকোনো বিরোধে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পথই সর্বোচ্চ সমাধান। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর এই পথই আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এটারই অনুসরণ করবে এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে।’
(সুরা : আনআম, আয়াত : ১৫৩)
৩. স্বার্থবিরোধী সত্য মেনে নেওয়া : উবাদা (রা.) বলেন, ‘আমাদের থেকে যে ওয়াদা তিনি (নবীজি) গ্রহণ করেছিলেন তাতে ছিল যে আমরা আমাদের সুখে-দুঃখে, বেদনায় ও আনন্দে এবং আমাদের ওপর অন্যকে অগ্রাধিকার দানে
পূর্ণরূপে শোনা ও মানার ওপর বায়াত করলাম। আরো (বায়াত করলাম) যে আমার ক্ষমতাসংক্রান্ত বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঝগড়া করব না। কিন্তু যদি স্পষ্ট কুফরি দেখ, তোমাদের কাছে আল্লাহর তরফ থেকে যে বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান, তাহলে আলাদা কথা।’
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭০৫৬)
৪. অপরাধ ও অপরাধীর পক্ষ ত্যাগ : বিরোধ মীমাংসার অন্যতম শর্ত হলো, অপরাধ ও অপরাধীর পক্ষ ত্যাগ করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের কী হলো যে তোমরা মুনাফিকদের সম্পর্কে দুই দল হয়ে গেলে, যখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তোমরা কি তাকে সৎপথে পরিচালিত করতে চাও? এবং আল্লাহ কাউকে পথভ্রষ্ট করলে তুমি তার জন্য কখনো কোনো পথ পাবে না।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ৮৮)
৫. আক্রমণাত্মক আচরণ পরিহার করা : যারা সত্যিই মীমাংসা ও সমাধান চায়, তাদের অবশ্যই আক্রমণাত্মক আচরণ পরিহার করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দাদের যা উত্তম তা বলতে বলো। নিশ্চয়ই শয়তান তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে উসকানি দেয়; শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।’
(সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৫৩)
৬. একতাকে আল্লাহর অনুগ্রহ মনে করা : একতাকে আল্লাহর অনুগ্রহ মনে করলেই বিরোধ নিষ্পত্তি করা সহজ হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তিনিই তাদের পরস্পরের হৃদয়ে প্রীতি দান করেছেন। পৃথিবীর সব সম্পদ ব্যয় করলেও তুমি তাদের অন্তরে প্রীতি স্থাপন করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৬৩)
রাষ্ট্রের করণীয়
মুসলিম সমাজের কোনো দুটি পক্ষ যদি পরস্পরের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব প্রথম তাদের ভেতরে আপস-মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়া। সেটা সম্ভব না হলে অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে ইনসাফের সঙ্গে শক্তি প্রয়োগ করা। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের দুটি দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে; আর তাদের একদল অপর দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে—যদি তারা ফিরে আসে তাদের মধ্যে ন্যায়ের সঙ্গে ফায়সালা করবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন।’
(সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ৯)
বিরোধ মীমাংসার মহাপুরস্কার
মুসলমানের পারস্পরিক বিরোধের মীমাংসার মহাপুরস্কার ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন, ‘আমি কি তোমাদের রোজা, নামাজ ও সদকার চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কাজের কথা বলব না? সাহাবিরা বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বললেন, পরস্পরের মধ্যে মীমাংসা করা। আর পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া বাধানো ধ্বংসের কারণ।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৯১৯)