থার্টি ফার্স্ট রাতের যথেচ্ছ হারাম
মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী
মুসলিম শব্দের অর্থ হচ্ছে আত্মসমর্পণকারী, অর্থাৎ নিজের ইচ্ছা ও স্বাধীনতায় চালিত নয়। বরং আল্লাহতায়ালার আদেশ ও নিষেধ পালন করেই তার জীবন পরিচালিত হবে। মুসলিম জীবনের আনন্দ-উৎসব আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ ও অশ্লীলতায় নিহিত নয়। মুসলিম জীবনের আনন্দও আল্লাহর হুকুমে হয়। তা ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হয়। কেননা মুসলিমের ভোগবিলাসের স্থান ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী নয়, বরং চিরস্থায়ী জান্নাত। মুসলিম জীবনের প্রতিটি কাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িত থাকবে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, তাদের ইমান, আমল, আখেরাতের প্রতি তাদের অবিচল বিশ্বাস, আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালোবাসা।
ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখের দিবাগত রাতকে থার্টি ফার্স্ট নাইট বলা হয়। যা শিষ্টাচার বিবর্জিত, উন্মত্ত নগ্নতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতায় উদ্বুদ্ধকারী পাশ্চাত্য কালচার। এতে যেমন সামাজিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়, রাষ্ট্রীয় শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হয়, ঠিক তেমনি যুবসমাজের চারিত্রিক মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসে। যা কোনো একজন মুসলিমের কখনোই কাম্য হতে পারে না। বর্ষবরণের নামে এ রাতকে ঘিরে পশ্চিমাদের যে কত আয়োজন তার কোনো শেষ নেই। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো, আজ মুসলমানও এ আয়োজনে পিছিয়ে নেই। আতশবাজি, পটকাবাজি, নাচ-গান, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা, মাদক সেবন, নারীর শ্লীলতাহানি, জিনা-ব্যভিচারসহ কত কিছুই না হচ্ছে এ রাতে। অথচ পৃথিবীর কোনো ধর্মই শিষ্টাচারবহির্ভূত, মানবতাবিরোধী এসব কর্মকাণ্ডের বৈধতার পারমিশন দেয় না। বরং প্রতিটি ধর্মের একদল উচ্ছৃঙ্খল, অসভ্য, অসামাজিক মানুষের অসুস্থ মনমানসিকতার নিঃসৃত বিকৃত আনন্দ-উৎসব। এসব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের অনুসরণ ব্যতীত অন্য কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। আজ আমাদের মাঝে নিম্নোক্ত হাদিসের বাস্তব প্রতিফলন পরিপূর্ণভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং আমাদের যুবসমাজ নিষিদ্ধ কৃষ্টি-কালচারের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকৃষ্ট হয়ে, চারিত্রিক ও ইমান-আমলের সম্পূর্ণরূপে ধস নেমে এসেছে।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা নিশ্চয়ই তোমাদের আগের উম্মতদের পদে পদে অনুসরণ করে চলবে। এমনকি তারা যদি গুইসাপের গর্তেও ঢুকে থাকে তোমরাও তাতে ঢুকবে। বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শুনে আমরা নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রসুল! আগের উম্মত বলতে কি আপনি ইহুদি ও নাসারাদের বোঝাচ্ছেন? তিনি বললেন, তবে আর কারা হবে। (সহিহ বুখারি) থার্টি ফার্স্ট উদযাপনের নামে এ রাতে যা যা হয়, এর প্রত্যেকটি অত্যন্ত জঘন্যতম গুনাহ এবং ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয়ের কারণ। আতশবাজি, পটকাবাজি, আলোকসজ্জা ইত্যাদি একদিক থেকে যেমন মুশরিকদের কাজ, তেমনিভাবে অন্য ভাইদের জন্য কষ্টের কারণও বটে। এর দ্বারা অন্যদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। বিশেষ করে বৃদ্ধ, রোগী ও শিশুদের অনেক কষ্ট হয়, যা স্পষ্ট হারাম। কেননা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রকৃত মুসলিম সেই ব্যক্তি যার জিহ্বা এবং হাত থেকে অপর মুসলিম নিরাপদ থাকে। আর প্রকৃত মুহাজির ওই ব্যক্তি, যে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ ত্যাগ করে চলে (সহিহ বুখারি)।
এ রাতে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ লক্ষ্য করা যায়, যা সুরা আহজাব ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। এ রাতে ব্যাপক নাচ-গানও বাদ্য-বাজনার আয়োজন করা হয়, যা এমনিতেই নাজায়েজ। উপরন্তু দীনদার লোকদেরও শুনতে বাধ্য করা হয় এবং সবার রাতের আরামের ঘুম হারাম করে দেওয়া হয়। নবীজি ইরশাদ করেন, অবশ্যই আমার পরে এমন কিছু লোক আসবে, যারা জিনা, ব্যভিচার, রেশম, নেশাদার দ্রব্য, গানবাজনা ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে (সহিহ বুখারি)। নবীজি আরও এরশাদ করেন, তোমরা গায়িকা নর্তকীদের বিক্রয় করো না কিংবা তাদের ক্রয় করো না অথবা তাদের গানবাজনা ও বাদ্যযন্ত্র শিখিয়ে দিও না, কারণ তাদের উপার্জন হারাম (মিশকাত)। বড় আফসোসের বিষয়, হিজরি নববর্ষ মুসলমানদের জন্য ইমান-আমল রক্ষা করার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ আমরা মুসলমান হয়েও বর্ষ শেষ হওয়া এবং শুরু হওয়া এবং প্রথম মাস মহররম সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে গাফেল অবস্থায় থাকি। একজন মুসলিম বছর শেষ হওয়ার পর, সে আফসোস করবে লম্বা একটি সময় তার জীবন থেকে চলে গেল এই সময়ের মধ্যে সে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করতে পারেনি এবং বড় কোনো ইবাদত করতে পারেনি। এজন্য আল্লাহপাকের দরবারে আফসোস করবে, তওবা করবে বিগত জীবনের কৃত অপরাধের জন্য এবং সামনের জীবনে বড় নেক কাজ করে আল্লাহকে খুশি করবে আল্লাহর হুকুম পুরোপুরিভাবে পালন করবে এই অঙ্গীকার করে নতুনভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। এটাই হবে আমাদের মুসলমানদের করণীয় কাজ। জঘন্যতম গুনাহসমূহের দ্বারা আনন্দ উল্লাসে মত্ত হওয়া কোনো মুমিনের কাজ হতে পারে না, কারণ যে কোনো সময় আমার দুনিয়ার সময় শেষ হয়ে আমি মৃত্যুবরণ করতে পারি। তার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা উচিত। কেননা দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা এবং কাফেরদের জন্য আনন্দের বেহেশতখানা। আল-হাদিস
লেখক : ইমাম ও খতিব কাওলার বাজার জামে মসজিদ দক্ষিণখান, ঢাকা