গবেষণায় আত্মচৌর্যবৃত্তির অভিযোগ শাবিপ্রবি ও পাবিপ্রবি ৩ শিক্ষকের বিরুদ্ধে

শাবিপ্রবি প্রতিনিধি
পূর্বে আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ পুনরায় অন্য একজন গবেষকের বইয়ে প্রকাশের মাধ্যমে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণায় আত্মচৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে। তবে এতে চৌর্যবৃত্তি হয়নি বলে দাবি সংশ্লিষ্ট গবেষকদের। কিন্তু এটাকে স্পষ্ট চৌর্যবৃত্তি ও গবেষণা নৈতিকতার পরিপন্থী বলে দাবি করছেন বিশেজ্ঞরা।
চৌর্যবৃত্তিতে অভিযুক্ত গবেষকরা হলেন, শাবিপ্রবি ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হিমাদ্রি শেখর রায় এবং পাবিপ্রবি ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাশেদ মাহমুদ ও সহকারী অধ্যাপক ইব্রাহিম খলিল।
চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত মূল প্রবন্ধটি হল- ‘দ্য প্রোজেকশন অফ সাবমিশিভ অ্যান্ড রেভল্যুশনারি উইমেন ইন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’স ট্রি উইথআউট রুটস: এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’। যেটি ২০২১ সালে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ এন্ড লিটারেচার স্টাডিজ’ জার্নালে প্রকাশিত হয়।
পরবর্তীতে একই গবেষণা প্রবন্ধ ২০২২ সালে ‘দ্য পোরট্রেয়াল অব সাবমিশিভ অ্যান্ড রেবেলিয়াস রুরাল বেঙ্গালি উইমেন ইন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’স ট্রি উইথআউট রুটস’ শিরোনামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক নিয়াজ জামান প্রকাশিত ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: এ সেঞ্চুরি ট্রিবিউট’ বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রবন্ধটির গবেষকদের ভাষ্য, পূর্বে প্রকাশিত প্রবন্ধদের ভূমিকা ও উপসংহার কিছু জায়গা পরিবর্তন করে বাকি সব একই রেখে সম্পাদক তাদের লেখাটি ছাপিয়েছেন।
এদিকে কোন প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে হবুহু তুলে দেওয়া বা কিছু শব্দ পরিবর্তন করে তুলে দেওয়াকে পুরোপুরি অনৈতিক বলে দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শাবিপ্রবির একাধিক বিজ্ঞ গবেষক বলেন, কোন প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে কোন ডেটা,তথ্য বা লেখা কারো গবেষণায় প্রবন্ধে যোগ করার প্রয়োজন হয়, অথবা গবেষকের নিজের প্রবন্ধ থেকেও যদি যোগ করার প্রয়োজন পড়ে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই প্রকাশিত জার্নাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। তবে এক্ষেত্রে আরও বাঞ্চনীয় যে, কোন লেখা গবেষক হুবহু না লিখে গবেষকের সৃজনশীল ভাবনা, চিন্তা ও বোঝাপড়া থেকে গবেষকের ভাষায় লিখতে হবে। সে সাথে ওই প্রবন্ধের সাইটেশন দেওয়া বাধ্যতামূলক। নতুবা এটি পুরোপুরি প্লেজারিজম হিসেবে গণ্য হবে।”
অথচ এদিকে শাবিপ্রবি ও পাবিপ্রবি এ তিন গবেষকের পুনরায় প্রকাশিত প্রবন্ধের প্রাপ্তিস্বীকারে পূর্বের প্রকাশিত প্রবন্ধের কোন সাইটেশন উল্লেখ করা হয়নি। একইসঙ্গে লেখাতেও ভূমিকা ও উপসংহারে ব্যতীত অন্য কোথাও পরিবর্তন আনা হয়নি। যা আন্তর্জাতিক গবেষণা নীতিমালার সাংঘর্ষিক ও অনৈতিক বলে দাবি করছেন বিজ্ঞ গবেষকরা।
এ বিষয়ে পাবিপ্রবি ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষণা জার্নালের করেসপন্ডিং অথর ইব্রাহিম খলিল বলেন, “এটা আইএসবিএন যুক্ত অনেকগুলো প্রবন্ধ নিয়ে একটা কম্পাইলেশন বই। বইটির সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিয়াজ জামান আমাদের সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে একটা প্রকাশনা প্রকাশের জন্য ইচ্ছাপোষণ করে ইমেইল করে। তাই আমরাও পূর্বে প্রকাশিত প্রবন্ধটি প্রকাশিত জার্নাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে ওনাকে দিয়ে দেই। কারণ আমাদের মনে হয়ছে নিয়াজ জামান ম্যাম এত বড় একজন গবেষক। ওনিতো নিশ্চয়ই অনুমতি বিষয়ে জানে। যদি অনুমতির প্রয়োজন হতো, তাহলে তো ওনি এভাবে ইমেইলে প্রবন্ধটি প্রকাশের জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করতো না।”
পাবিপ্রবির একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও এ প্রবন্ধের লেখক রাশেদ মাহমুদ বলেন, “নিয়াজ জামান ম্যাম সৈয়দ ওয়ালী উল্যাহর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন গবেষণার প্রবন্ধের সংকলনের উদ্যোগ নেয়। তখনকার সময় আমাদের কাছে সময় কম থাকার কারণে জার্নাল কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতি নেওয়া সম্ভব হয়নি।”
তিনি বলেন, “এখন যে অভিযোগ করা হচ্ছে, নিয়াজ জামানের প্রকাশিত বইয়ে আমাদের প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধটির পূর্বের প্রকাশিত জার্নালের কোন সাইটেশন দেওয়া হয়নি। এটা ভুলক্রমে নিয়াজ জামান ম্যাম বইয়ে যোগ করেননি।”
প্রবন্ধটির আরেকজন লেখক শাবিপ্রবি ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হিমাদ্রী শেখর রায় বলেন, “অধ্যাপক নিয়াজ জামান ম্যামের প্রকাশিত বইটা সবগুলো আর্টিকেলের একটা কম্পাইলেশন। ওখানে তিনি আমাদের প্রবন্ধের ভূমিকা ও উপসংহার অনুমতিক্রমে একটু পরিবর্তন করেছেন। এখন যদি জার্নাল কর্তৃপক্ষের কোন অনুমতির প্রয়োজন হয়, সেটা নেওয়ার দায়িত্ব সম্পাদকের। একই সাথে প্রকাশিত প্রবন্ধ যোগ করলে তার সাথে সাইটেশনও যুক্ত করা দায়িত্ব তার। সেটা তিনি করেন নি। এটা ওনার ভুল। এজন্য ওনি আমাদের কাছে ও ফেইসবুক পোস্টের মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং পরবর্তী সংস্করণে সাইটেশন যোগ করে দিবে বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।”
তিনি আরও বলেন, “কিছু জার্নালের সিস্টেম হচ্ছে অনুমতির জন্য ইমেইল করলে কোর রিপ্লাই-ই দেয় না, ওটা নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। অলরেডি পাবলিশড, পাবলিশড। এজন্য সম্পাদকের দায়িত্ব সাইটেশন যোগ করে দেওয়া।”
এ বিষয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: এ সেঞ্চুরি ট্রিবিউট বইয়ের সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক নিয়াজ জামান বলেন, “আমি এ প্রবন্ধটা অনলাইনে পড়েছিলাম। লেখকের অনুমতি চেয়ে সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ সম্পর্কে নতুন ও পুরাতন প্রবন্ধ নিয়ে একটা বই প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। এজন্য তাদেরকে ইমেইল করি এবং তাড়া সাড়া দেয়।”
“আমার একটাই ভুল হয়েছে, আমি ওই তিনজন গবেষকের প্রবন্ধটি আমার বইয়ে যোগ করার সময় প্রবন্ধটি পূর্বে প্রকাশিত জার্নালের সাইটেশন সংযুক্ত করিনি। এটা যোগ করা উচিত ছিল। এ প্রবন্ধটি প্রকাশের জন্য ওনারা আমাকে কোন টাকা দেয় নাই, আমিও দেয় নাই।”
প্রবন্ধটি সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে পূর্বে প্রকাশিত জার্নালের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কিনা এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “আপনি উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না। আপনি কি জানেন, আমরা কোথায় আছি? অনুমতি নেওয়ার দায়িত্ব তাদের। আমি জানি না, তারা অনুমতি নিয়েছে কিনা।”
শাবিপ্রবি গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, “প্লেজারিজমের অভিযোগে কোন গবেষকের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য গবেষণা কেন্দ্রকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন অনুমতি দেয়নি। এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইলে বা গবেষণা কেন্দ্রকে অনুমতি প্রদান করলে পদক্ষেপ নিতে পারবে।”
শাবিপ্রবির উপ উপাচার্য অধ্যাপক সাজেদুল করিম বলেন, “এরকম কোন ইস্যু যদি আমাদের নজরে আসে বা কেউ অভিযোগ করে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।”
এ বিষয়ে পাবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক এস এম আব্দুল আওয়ালের সাথে একাধিক বার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কোন সাড়া পাওয়া যায় নি।