চুক্তির পরও যুক্তরাজ্যে ১১ দিনে ২৫০০ অভিবাসী পৌঁছেছে
অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে ফ্রান্স-যুক্তরাজ্যের ‘ওয়ান ইন, ওয়ান আউট’ চুক্তি কার্যকর হওয়ার পরও মাত্র ১১ দিনে আড়াই হাজারেরও বেশি অভিবাসী ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ব্রিটিশ উপকূলে পৌঁছেছে। ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রবিবার এ তথ্য জানিয়েছে।
‘ওয়ান ইন, ওয়ান আউট’ চুক্তি অনুসারে ফ্রান্সের উপকূল থেকে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে আসা প্রত্যেক অভিবাসীকে আটক করে ফেরত পাঠাবে যুক্তরাজ্য। বিনিময়ে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আশ্রয় চাওয়া সমানসংখ্যক অভিবাসীকে ফ্রান্স থেকে নিয়মিত পথে আসার সুযোগ দেবে দেশটি।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত ছোট নৌকায় অন্তত ২৮ হাজার অভিবাসী যুক্তরাজ্যে পৌঁছেছে। আর ২০২৪ সালের জুলাইয়ে লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে অন্তত ৫০ হাজার অভিবাসী ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ব্রিটিশ উপকূলে পৌঁছেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘অভিবাসীরা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে, তা নিয়ে মানবপাচারকারী চক্রগুলোর কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা শুধু বোঝে অর্থ আদায় করা।
তিনি আরো বলেন, ‘এ কারণে এই সরকার এই চক্রগুলোর ব্যাবসায়িক মডেল ভেঙে দিতে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এ জন্য ইংলিশ চ্যানেলে ছোট নৌকা পারাপার ঠেকাতে ফ্রান্সের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি ছোট নৌকায় আসা অভিবাসীদের আটক করে ফ্রান্সে ফিরিয়ে দিতে পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়েছে।’
এনজিওকর্মী রব লরি শুক্রবার বিবিসি টুডে অনুষ্ঠানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চোরাচালানকারীরা মনে করে একটি নৌকায় অন্তত ১৫০ জন অভিবাসীকে তোলা সম্ভব। তিনি আরো বলেন, অনেক মানুষকে গাদাগাদি করে নৌকায় তোলা হয়।
এর ফলে নৌকা উঠার সময় তাড়াহুড়ার কারণেই শুধু নয়, বরং ডিঙ্গি নৌকার মধ্যে পদপিষ্ট হয়ে শিশুদের মৃত্যুর খবরও আসে বলে জানান তিনি। চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার সময় কতসংখ্যক মানুষ সমুদ্রে ভেসে গেছে তারও কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই বলে দাবি করেন রব লরি।
গ্রীষ্মের সময় চ্যানেলের আবহাওয়া শান্ত থাকায় পারাপার বেড়ে যায়। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের আগস্টে চার হাজারের বেশি অভিবাসী ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিল।
চলতি বছরের জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যে সফরে করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ।
ওই সময় অভিবাসী বিনিময় বিষয়ক ‘ওয়ান ইন, ওয়ান আউট’ চুক্তিতে সই করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ। এই চুক্তির আওতায় ৬ আগস্ট যুক্তরাজ্যে পৌঁছনো অভিবাসীদের প্রথম দল হিসেবে ডোভার বন্দরে আটক করা হয়। তবে তাদের এখনো ফ্রান্সে ফেরত পাঠানো হয়নি। বিবিসি বলছে, এসব অভিবাসীকে ফ্রান্সে ফেরত পাঠাতে মাস তিনেক পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসার পর ইংলিশ চ্যানেলে সক্রিয় মানবপাচারকারী চক্রগুলো ভেঙে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে তারা এ কথাও জানিয়েছে, এ জন্য সময় লাগতে পারে।
এদিকে অনিয়মিত অভিবাসীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলায় রাজনৈতিক চাপের মুখে রয়েছে ব্রিটিশ সরকার। দেশটিতে ডানপন্থীদেরও উত্থান ঘটছে। কিন্তু নতুন চুক্তির আলোকে অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো শুরু না হওয়া পর্যন্ত এই পদক্ষেপে কতটা সুফল মিলবে, সেটিও স্পষ্ট হচ্ছে না।
ফ্রান্স থেকে যাওয়া অভিবাসীদের আটক সম্পর্কে কিয়ার স্টারমার বলেছেন, ‘আপনি যদি এই দেশে আইন ভঙ্গ করে আসেন, তাহলে আপনাকে ফিরে যেতে হবে। কারণ, যখন আমি বলি, আমাদের সীমান্ত সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই, আমি সেটা দায়িত্ব নিয়েই বলি।’
ফ্রান্সের সঙ্গে করা এই চুক্তির প্রাথমিক মেয়াদ ধরা হয়েছে ১১ মাস। বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস ফিলপ সরকারের এই নতুন চুক্তির সমালোচনা করেছেন। তার মতে, এই চুক্তিতে ‘কোনো প্রতিরোধমূলক প্রভাব নেই’।
অবশ্য যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি জানিয়েছে, মানবপাচারকারীদের ব্যাবসায়িক মডেল ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা কিছুটা সাফল্য পেয়েছে। গত সপ্তাহে বুলগেরিয়ায় একটি লরি থেকে চ্যানেলের উদ্দেশে রওনা হওয়া ২০টি নৌকা জব্দ করা হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে এটি ছিল এ ধরনের দ্বিতীয় অভিযান। সরকার বলেছে, এই ঘটনা অনিয়মিত অভিবাসন মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার একটি উদাহরণ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ছোট নৌকায় আসা অভিবাসীদের মধ্যে শীর্ষে ছিল আফগান নাগরিকরা। দ্বিতীয় বৃহত্তম দলটি হলো সিরীয় নাগরিক। এর পরই আছে ইরান, ভিয়েতনাম ও ইরিত্রিয়ার নাম। সরকার জানিয়েছে, মোট আগমনের ৬১ শতাংশ হলো এই পাঁচ দেশের নাগরিক।
২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চাওয়া এক লাখ আট হাজার মানুষের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ছোট নৌকায় ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে দেশটিতে গিয়েছিল।
যুক্তরাজ্যে থাকার আইনি অধিকার না থাকা ব্যক্তিদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে কঠোর হচ্ছে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি একটি বিদেশি রাষ্ট্রে আশ্রয় চাইতে পারে, যদি তিনি নিজ দেশে গুরুতর জীবননাশের হুমকিতে থাকে অথবা স্বাধীনতা উপভোগ করতে না পারে।