এমপি সাহেবের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র
দৈনিক সিলেট ডট কম
নঈম নিজাম : যাহা ৫৭ তাহা ৩২। একই। আমি মনে করি, কোনো আইনই খারাপ নয়। আইনের ব্যবহার কীভাবে হবে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। ধারার নাম যাই হোক না কেন প্রয়োগ নিয়ে হলো কথা। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা ৩২ ধারা নিয়ে মন্ত্রীদের বক্তব্য; যা আতঙ্ক তৈরি করছে মিডিয়ায়।
মন্ত্রীরা বলছেন, ‘এই আইন করা হচ্ছে এমপিদের মান-ইজ্জত রক্ষার জন্য।’ ভালো। আমাদের সব এমপির চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। তারা খারাপ কোনো কাজ করতে পারেন না। জীবনে কোনো দিনই করেননি। ভবিষ্যতেও করবেন না। তাদের সন্তান, আত্মীয়স্বজনরাও করবেন না। নির্বাচনী এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা কেউ ভুলেও চিন্তা করেন না। টিআর, কাবিখা নিয়ে কোথাও কোনো অভিযোগ নেই।
কারও আত্মীয় মাদক ব্যবসার অপরাধে আটক হননি। কোনো এমপিকে মাদকের গডফাদার বলা হয় না। নির্বাচনী এলাকায় স্কুলের দফতরি থেকে শুরু করে পুলিশের সিপাহিসহ সব নিয়োগে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। এখানে সবাই সাধু। কেবল মিডিয়ার লোকজনই এখন গুপ্তচর। সব এমপি খারাপ আমি তা বলছি না। সৎ, নিষ্ঠাবান অনেক এমপি রয়েছেন।
জনপ্রতিনিধি হিসেবে তারা দিনরাত জনগণের জন্য কাজ করেন। মানুষের কল্যাণকামী এমপি, মন্ত্রীর সংখ্যাই বেশি। খারাপের সংখ্যা বরং খুবই কম। এই কম ব্যক্তিদের অপকর্ম নিয়ে কি লেখা যাবে না? নেতিবাচক ইমেজের এই মানুষগুলোর গ্যারান্টি কে দেবে? আরেকটা কথা— হয়তো তারা আজ ভালো কাল কী হবেন? তাদের অপরাজনীতি নিয়ে না লিখলে তারা ভয়ঙ্কর মানুষে রূপান্তরিত হবেন। এই ভয়ঙ্কর খারাপ মানুষের দায় আওয়ামী লীগ কেন নেবে?
এখন আসি টাঙ্গাইলের একজন এমপির বিষয়ে। এই এমপি সাহেব এখন কারাগারে। অনেক দিন থেকে তিনি কারাভোগ করছেন। দলের একজন ত্যাগী নেতাকে খুনের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তিনি জামিন পাচ্ছেন না। আইনের চোখেও তিনি অপরাধী। তার মান-ইজ্জত কীভাবে রক্ষা হবে? আরেকজন এমপিকে বলা হয় ইয়াবার গডফাদার। তিনিও আটক হয়েছিলেন এক মামলায়। এখন তার বিরুদ্ধে কি লেখা যাবে না?
লিখলে ৩২ ধারা দিয়ে দেবে। অথবা সংসদে সাংবাদিককে তলবের দাবি উঠবে। সাংবাদিকরা হয়ে যাবেন গুপ্তচর। বড় আজব ব্যাপার। কথা দিচ্ছি ভালো কাজ করুন। মিডিয়া আপনাদের ভালো কাজ তুলে ধরছে, ধরবে। এমপি যখন দখল রাজনীতি করবেন, দলীয় কর্মী হত্যা করবেন, তখন মিডিয়ার কী করার থাকবে? আর সব এমপি সাহেবের পেশা কিন্তু রাজনীতি নয়। হলফনামায় আগে অনেকে লিখতেন পেশা রাজনীতি।
এখন লিখছেন ব্যবসা-বাণিজ্য। এই বাণিজ্য ঢাকা শহরে করলে সমস্যা ছিল না। সমস্যা নিজের এলাকার উন্নয়ন কাজে কমিশন বাণিজ্য করলে। টিআর, কাবিখা বিক্রি করলে। একজন এমপি অবশ্যই সম্মানিত মানুষ। মানুষের ভোটে নির্বাচিত। মানুষের কাছে তার অনেক অঙ্গীকার থাকে। জনগণকে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণ করতে গিয়ে সবসময় আইনমতো চলাও যায় না।
কিন্তু কর্মী ঠকিয়ে নিজের স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে রাজনীতির নামে কমিশন আর দখল বাণিজ্য করলে খবর শুধু মিডিয়াতেই আসে না, দলের কর্মী ও সাধারণ মানুষও হতাশ হয়। কষ্ট পায়। বাংলাদেশে এখন এমন এলাকার সংখ্যা অনেক। এমপিরা হিসাব-নিকাশ করে চললে সমস্যা নেই। হিসাবি এমপির সংখ্যাই বেশি। সমস্যা বেহিসাবি আর বেপরোয়াদের নিয়ে।
সেদিন একজন বললেন, ৩২ ধারা নিয়ে কারা খুশি জানেন? বললাম কারা? জবাবে শুনলাম, বেপরোয়ারাই খুশি বেশি। খুশিতে থাকা মানুষদের বলছি, বিশেষ ক্ষমতা আইনের কথা স্মরণ করুন। আওয়ামী লীগ আইনটি করেছিল। কিন্তু এর অপপ্রয়োগ সবচেয়ে বেশি হয়েছিল আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর। বিশেষ করে ’৭৫ সালের পর। এমনকি বিশেষ ক্ষমতা আইনে আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতাও কারাভোগ করেছেন।
সেই সিনিয়র নেতাদের অনেকে এখন মন্ত্রী। কিন্তু পুরনো কথা কারও মনে থাকে না। ভুলেও যান সবাই, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। আজকের বাদশাহ কাল ফকির। জগৎ বড় রহস্যময়। তাজমহলের সৌন্দর্যে আমরা বিমোহিত হই। কিন্তু সম্রাট শাহজাহানকে কেউই মনে করি না। শেষ জীবনটা নিঃসঙ্গ ছিলেন। পুত্র তাকে বন্দী করে অভিযোগ আনেন অর্থের অপব্যবহারের। ইতিহাসকে স্মরণে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিএনপি, জাতীয় পার্টির মতো দল নয় আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশের গণমানুষের একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এই ঐতিহ্যবাহী দলটি। শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষের শেষ ঠিকানা। সবাই ইতিহাসের সঙ্গে চলে। আর আওয়ামী লীগ ইতিহাস তৈরি করে। ’৭১ আমাদের অহংকার। এ অহংকার তৈরি করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে কোনো ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু সবকিছু প্রচলিত আইনেই সম্ভব।
কারণ, সংবিধানের ৩২ ধারায় পরিষ্কার রয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ এখন আমি সংবাদ করলে আপনি মামলা করবেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা করাবেন পুরনো মামলায়। আবার সংসদেও তলব করবেন। কিন্তু আইনপ্রণেতা হিসেবে মনে রাখুন, সংবিধানের ৩৯ ধারা চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করেছে। আর এই সংবিধান আওয়ামী লীগের তৈরি। কষ্টার্জিত স্বাধীনতাও আওয়ামী লীগের তৈরি।
তাই অসুস্থ চিন্তার মানুষ বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করলে তাদের আইনের কাঠগড়ায় অবশ্যই দাঁড় করাতে হবে। কিন্তু এর জন্য ৩২ ধারার দরকার আছে বলে মনে করি না। রাষ্ট্রে এমন বিচিত্র অবস্থানের যৌক্তিকতা নেই। রাষ্ট্র কার জন্য? জনগণের জন্য। তাই জনস্বার্থে তৈরি করতে হবে আইন-কানুন। ব্যবহারও হতে হবে মানুষের কল্যাণে। কিন্তু শুধু এমপি সাহেবদের রক্ষার জন্য আইন করা হলে তা হবে প্রশ্নবিদ্ধ। এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান আরও পরিষ্কার হওয়া দরকার।
মনে রাখা দরকার, আজ যে আইন আপনি অন্যের জন্য করলেন, কাল এ আইন আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার হতে পারে। তাই সময় থাকতে সাধু সাবধান! কারণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যা খুশি তা করতে পারে না। এখনো সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার জায়গাটুকু এখানেই। আরেকটা বিষয় বলতে চাই না। তবুও বলতে হচ্ছে, এখনকার সব এমপি কি আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাবেন? আর পেলেও তারা কি জয়ী হতে পারবেন? ২০১৪ সালের নির্বাচনের কথা কি আমরা ভুলে গেছি?
অবশ্যই স্বীকার করতে হবে সেই নির্বাচন অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল না। তার পরও অনেক এলাকায় নৌকার বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কঠিন লড়াই আমরা দেখেছিলাম। যারা শক্তভাবে মাঠে ছিলেন, তারা স্বতন্ত্র হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন। জয়ী না হলেও লড়াই করেছেন। এবারকার ভোট হবে অনেক কঠিন। অতীতের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের। আর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে সহায়তা করতে পারে মিডিয়া। জোর করে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ভালোবাসা দিয়ে মিডিয়া কাছে টানা যায়।
মানুষের কল্যাণ করে মিডিয়ার খবর হওয়া যায়। আবার সন্ত্রাস আর গম বিক্রি করেও হওয়া যায়। ব্রিটিশ শাসনকালে কবি মুকুন্দ দেব তিন বছর জেল খাটলেন এক কবিতা লিখে। কিন্তু জেলে বসেই তিনি অনেক বেশি লেখালেখি করেছেন। একই অবস্থান ছিল কবি নজরুলের। শরত্চন্দ্রের উপন্যাস ‘পথের দাবী’ নিষিদ্ধ হলেও লেখক থামেননি। আমি মনে করি, বর্তমানে বেশির ভাগ মিডিয়াই সরকারের পক্ষে। বিপক্ষে মিডিয়ার সংখ্যা কম। ব্যক্তিবিশেষের ভুল তুলে ধরা মানে সরকারের বিরোধিতা নয়।
সরকারের সাফল্যগুলোও মিডিয়ায় উঠে আসছে। আগে উন্নয়ন জার্নালিজম এত শক্তিশালী ছিল না আমাদের দেশে। এখন উন্নয়ন জার্নালিজম অনেক বেশি হয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। মানুষ এখন শুধু ব্যর্থতা নয়, সাফল্যের খবরও বেশি শুনতে চায়। আমরা ভালো খবরগুলো প্রকাশ করলে মানুষ ইতিবাচকভাবে তা গ্রহণ করে। তাই ভালো খবরগুলো প্রকাশের পাশাপাশি এমপি সাহেবদের সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী কাণ্ডকীর্তিও তুলে ধরতে হবে। তাহলে সাধারণ মানুষ নিরাপদ থাকবে।
সমাজে অনাচার কমে যাবে। বৈষম্য দূর হবে। বিনা ভোটে নির্বাচিত অনেক এমপি এখন নিজেদের এলাকায় জমিদারতন্ত্র কায়েম করেছেন। এই জমিদারতন্ত্র সরকারের বিশাল অর্জনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ম্লান করছে। আমরা জানি ত্যাগী এমপিদের বড় অংশই তাদের এলাকায় উন্নয়ন সাফল্য তৈরি করেছেন। বর্তমান সরকারের সাফল্যের তালিকা অনেক দীর্ঘ। বিদ্যুৎ খাতে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে আওয়ামী লীগ।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৬০০ থেকে এখন ১৬ হাজার মেগাওয়াট। পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার বিস্ময়কর সাফল্য। জিডিপির এই বিশাল প্রবৃদ্ধি শেখ হাসিনার আরেকটি বড় অর্জন। এ অর্জন নিয়েই শেখ হাসিনা সামনে এগিয়ে চলেছেন। তার এই গতি কোনো প্রশ্নবিদ্ধ আইন দিয়ে ম্লান করা ঠিক নয় বলেই মনে করি।
সেদিন এক বন্ধু বললেন, আইনের দরকার ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণে। নারী ও শিশুদের হয়রানি বন্ধে। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে সমালোচনা বন্ধে। ডিজিটাল অগ্রগতি যেমন আছে তেমন অপব্যবহারও আছে। আমি বললাম, ব্রিটেনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আলোচিত নেতা ও প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল কিছু দিন সাংবাদিকতা করেন। সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে ২৫০ পাউন্ডে ব্রিটেনের মর্নিং পোস্ট পত্রিকায় তিনি যোগ দেন। যুদ্ধ সংবাদদাতা হিসেবে চলে যান দক্ষিণ আফ্রিকায়।
সেই সময় চার্চিলের সাহসী রিপোর্টগুলো দুনিয়া কাঁপিয়ে দেয়। তার জনপ্রিয়তা শীর্ষে চলে আসে। চার্চিল রাজনীতিতে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন এবং যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু সংবাদকর্মী হিসেবে চার্চিলের রিপোর্টগুলো নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে মত ছিল। অনেক ব্রিটিশ তার বিচারও দাবি করতেন নিয়মিত। কিন্তু চার্চিল তার অবস্থান থেকে সরেননি। লড়াইটা করেই গেছেন। সেই লড়াইয়ের কথা আমরা অনেকেই জানি।
মিসৌরি স্কুল অব জার্নালিজমের শিক্ষক প্রফেসর লরি আমাকে তার ক্লাসে একবার বলেছিলেন, সাংবাদিকতা সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ প্রভাবশালীদের কাছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন মিডিয়া কর্মীকে কাজ করে যেতে হবে তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে। সেই অর্জন আগামী দিনে কতটা সফল হবে আমাদের দেশে ৩২ ধারা রেখে জানি না। তবে এ আইনটি করার প্রক্রিয়ায় যারা ছিলেন, আছেন তারা ছায়ার সঙ্গে লড়াই করছেন।
ছায়ার সঙ্গে লড়াই করে দীর্ঘমেয়াদি কোনো লাভ নেই। সরকার যত বেশি মিডিয়াবান্ধব হবে জনগণ ও রাষ্ট্র তত বেশি লাভবান হবে। লড়াই কারও জন্যই সুখকর নয়। সামাজিক গণমাধ্যম নিয়ে নীতিমালা করলেই হয়। নাসিরনগর, পাবনা, রংপুর, রামুর মতো ঘটনা আমরা দেখতে চাই না। এ ধরনের ঘটনায় যারা জড়াবে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
নারী ও শিশুকে ইন্টারনেটে ছবি আপলোড করে যারা হয়রানি করবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। এর জন্য প্রচলিত আইন-কানুন আছে। এর সঙ্গে মূলধারার মিডিয়াকে জড়ানো যাবে না। জড়ালেই কিছু এমপি, প্রভাবশালী যা খুশি করার লাইসেন্স পেয়ে যাবেন; যা আগামীর জন্য হবে ভয়ঙ্কর।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন