একতরফা নির্বাচন বিপজ্জনক হতে পারে

এম এ আজিজ
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ৭ জানুয়ারি ২০২৪ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের তারিখ রেখে তফশিল ঘোষণা করেছেন; যা সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক আগেই জানান দিয়েছিলেন।
জনশ্রুতি আছে, সরকারের ইচ্ছাপূরণে অতিদ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ অনুভব করেছেন সিইসি। তাই ২৮ তারিখের বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে সংলাপের সুযোগ না রেখেই এ তফশিল ঘোষণা করেছেন। সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ভোটগ্রহণের আয়োজন করবে।
সে অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাচনের শেষ তারিখ ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি। সুতরাং, নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংকট বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্ভাব্য সংলাপ করার সময় দিতে সিইসি আরও ১৫-২০ দিন ভোটের তারিখ পিছিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা দেননি। এতে সরকারি দল বিএনপিকে বাইরে রেখে অতিদ্রুত নির্বাচন করার সুযোগ পেয়েছে।
অবশ্য, একজন ইসি কমিশনার বলেছেন, বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে এলে তফশিল পেছানো হবে এবং সব দলের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করার চেষ্টা করা হবে। আরেকজন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব পুলিশ বাহিনীর। এ ব্যাপারে ইসির কিছু করার নেই।
অপরদিকে, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির কেন্দ্র থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে দলটিকে নেতৃত্বশূন্য এবং নির্বাচনে সংসদ সদস্য প্রার্থীশূন্য করা প্রায় সম্পন্ন। সেই সঙ্গে অতিদ্রুত বিএনপির নেতাকর্মীদের জেল দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে মৃত ও গুম হওয়া তিনজনসহ কমবেশি ১৩৯ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দুই বছরের বেশি দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতারা জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন।
যা হোক, বিরোধী দলগুলো এ তফশিল প্রত্যাখ্যান করে ২৯ অক্টোবর থেকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বিরতি দিয়ে দিয়ে হরতাল-অবরোধ ডাকছে। ২২ নভেম্বর ভোর ৬টা থেকে আবারও ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ ডেকেছে। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট সংকট নিরসনের জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক হিসাবে খ্যাত প্রায় সব দেশসহ নিজেদের দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রত্যাশা করেছে।
এদিকে, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার এবং ‘লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ড’ ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। তাই ইসির তফশিল ঘোষণার পর দেশ একটি একপক্ষীয় নির্বাচনের পথে ঢুকে গেছে। এ বাস্তবতায় জনমনে প্রশ্ন, কৌতূহল ও উদ্বেগের অন্ত নেই। যেমন, একতরফা জাতীয় নির্বাচন কি ঝুঁকিপূর্ণ হবে? আগামী সংসদ নির্বাচনে কী হবে? বিএনপিবিহীন নির্বাচন কি সত্যিই হবে? হরতাল-অবরোধে কি সরকারের পতন হবে? কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা কি স্থায়ী হবে? দেশ কি বড় কোনো সংকটে পড়তে যাচ্ছে? সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কি হবে?
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কিছু ছোট রাজনৈতিক দল ও কয়েকটি ‘কিংস পাটি’র মধ্যে অল্পস্বল্প সংসদীয় আসন বণ্টন করে দিয়ে সরকারি দল নির্বাচনকে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করবে। সরকার মনে করে, জনগণ অংশগ্রহণ করলেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে, যে নির্বাচনে সর্বোচ্চসংখ্যক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে, যে রাজনৈতিক দলের অনেক ভোটার রয়েছে এবং যে রাজনৈতিক দলগুলোর জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে, সেই দলগুলো যদি স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, তাহলে তাকেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে।
উল্লেখ্য, দেশের কোনো বড় দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। তাই সব দলই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এ দলগুলোর মধ্য থেকে কোনো দল জনগণের ভোটে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলেও হয়ে ওঠে কর্তৃত্ববাদী শাসক, যার অধীনে কখনই অবাধ, সুষ্ঠু ও অংগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করা যায় না। তাই নির্বাচন হলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের ‘ওপেন সোসাইটি ব্যারোমিটার: ক্যান ডেমোক্রেসি ডেলিভার?’ শীর্ষক জরিপ এ মাসে বাংলাদেশসহ ৩০টি দেশে করা হয়েছে। জরিপে ৯১ শতাংশ বাংলাদেশি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে। ৮৮ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বিশ্বের কল্যাণের জন্য মানবাধিকার একটি বড় শক্তি। আবার, সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি (ভি-ডেম) ইন্সটিটিউট গত ১৬ নভেম্বর প্রকাশিত এক জরিপে দেখিয়েছে, ‘উদার গণতান্ত্রিক সূচকে’ ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম।
‘নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে’ ১৩১তম এবং শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে বাংলাদেশ ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্র’ বিভাগে। উদাহরণ হিসাবে কম্বোডিয়ার দিকে একটু নজর দিয়ে দেখতে পারি সে দেশের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের কতটুকু মিল বা অমিল আছে। যেমন- কম্বোডিয়ার সাবেক খেমাররুজ নেতা হুন সেন ১৯৮৫ সাল থেকে কঠোর হাতে কম্বোডিয়ার শাসনক্ষমতা দখলে রেখেছিলেন। তিনি বিরোধীদের দেশত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ও বাক্-ব্যক্তির স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন।
এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরশাসক’ হুন সেন ক্ষমতার ৩৮ বছর তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধীকে নিষিদ্ধ করে বা ঠুনকো অজুহাতে নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করতেন। তেমনি কম্বোডিয়ার সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনে দলীয় নিবন্ধনে ত্রুটি দেখিয়ে তার দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল ক্যান্ডললাইট পার্টিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে এবং একপক্ষীয় নির্বাচন করে তার দল কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টিকে (সিপিপি) প্রায় ৮২ শতাংশ ভোটে জয়ী করেছিলেন।
বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, মামলা, জেল, জুলুম, সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার, পুলিশসহ রাষ্ট্রের প্রশাসন ও আদালতকে নিয়ন্ত্রণে রেখে হুন সেন ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করেছিলেন। ক্ষমতা ধরে রাখার এসব অগণতান্ত্রিক কৌশল কেবলই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে, কিন্তু শেষ বিচারে দেশকে অনুন্নত করে রেখেছে। সত্তর বছর বয়সি কর্তৃত্ববাদী শাসক হুন সেনের দল সিপিপি জয়ী হওয়ার পরই তিনি পদত্যাগ করে স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রিত্ব তার বড় ছেলে অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান হুন মানেট-এর কাছে হস্তান্তর করেছেন।
নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে হুন মানেটও জয়ী হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব বলেছে, এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। প্রধান বিরোধী দলকে দমিয়ে রাখা হয়েছে। এতে মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতিফলন হয়নি। যার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কম্বোডিয়ার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
যা হোক, বাংলাদেশে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তৃতীয় দফায় একতরফা নির্বাচনে রাষ্ট্রের জন্য পাহাড়সম চাপ সৃষ্টি হতে পারে, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে এবং দীর্ঘদিনের জন্য পরাশক্তিগুলোর ভূ-রাজনীতির প্রতিযোগিতার স্নায়ুযুদ্ধের ভরকেন্দ্র হতে পারে বাংলাদেশ।
এ অবস্থায় সব রাজনৈতিক দলের সমঝোতার মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার যেমন নিশ্চিত করবে, তেমনি তা জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলবে। এটাই সব ধরনের বিদেশি চাপ মোকাবিলা করার সঠিক পথ।
এমএ আজিজ : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সূত্র:যুগান্তর