পাকিস্তানে গণজাগরণের দ্বিতীয় অধ্যায়
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
লাঠি, বন্দুক, টিয়ার গ্যাসের যথেষ্ট ব্যবহারের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে ভোটাভুটির যে উল্লম্ফন লক্ষ করা গেছে, তার জের টেনে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এখন তুঙ্গে। একদিকে তথাকথিত গণতন্ত্রমনা বিভিন্ন ধারার রাজনীতিবিদদের নানা অপকৌশলের প্রকোপ যেমন মাথাচাড়া দিয়েছে, ঠিক তেমনি অপর প্রান্তে সাধারণ জনগোষ্ঠীর ‘গোলামি নামঞ্জুর’ ধ্বনি রাজনীতির অঙ্গনে এক নতুন পথ-প্রদর্শনের ইঙ্গিত বয়ে চলেছে।
সেই ৭১-এর রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র বিপ্লবের পর এটাই পাকিস্তানে গণজাগরণের দ্বিতীয় অধ্যায়। শেষোক্ত এ ধাপে, অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নয়, বরং ভোটের শক্তিকে কেন্দ্র করে নিরস্ত্র জনগণ গণশত্র“দের পরাস্ত করার দৃঢ়তায় অনড়। এতে ক্রিকেট লিজেন্ড ইমরান খানকে তারা অগ্রদূত হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
এক খান সাহেবও হয়তো জনগণকে সঠিকভাবে বোঝাতে পেরেছেন ৪৭-এর স্বাধীনতা ছিল আসলে পরাধীনতার নবরূপ। তাই নব স্বাধীনতার ডাকে জনসমুদ্রে জেগেছে উত্তাল তরঙ্গ। ধর্ম, বর্ণ ও প্রাদেশিকতার জাল ছিঁড়ে দেশের আপমর জনগোষ্ঠী এখন একই কাতারে দণ্ডায়মান। দাবি স্বাধীনতার-যে স্বাধীনতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ, স্বদেশি কালা কুচক্রে কলঙ্কিত।
বলা বাহুল্য, ৮ ফেব্রুয়ারি ভোটকেন্দ্রে নামে মানুষের ঢল। নানা অপকৌশলের খুঁটি উপড়িয়ে তারা প্রমাণ করে জনগণই আসলে শক্তির উৎস।
যা হোক, জনতা কিন্তু ভোট দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি; ভোটের পাহারাদারিত্বেও তারা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের বাইরে তাদের ধরনা রয়েছে অব্যাহত। আর আইনের লড়াই লড়ছেন নেতারা। এদের অনেকেই কিন্তু আইনের লোক। নামকরা উকিল।
আদালতে একের পর এক যুক্তি দিয়ে চলেছে তারা। হাতে তাদের ভোটকেন্দ্র থেকে মহরকৃত ফলাফলের পর্চা। এগুলো তাদের বাজিমাতের অমোঘ অস্ত্র। নিজেদের জিত নিশ্চিত করতে তারা আদালতের ওপর রেখেছে জোরালো চাপ। ফলে, আদালত ভোটের পূর্ণ ফলাফল প্রচারে ব্রেক লাগিয়ে দিয়েছে। ব্রেক তো লাগিয়েছে ঠিক। কিন্তু, কেসগুলোর শুনানি চালাতে রাজি হননি জজ সাহেব। বলেছেন, এগুলো ইলেকশন কমিশনের আওতায়।
এখানকার দরজায় খটখটাতে হবে প্রথমে বলে মন্তব্য করেছেন তারা। তাই তো পিটিআইকে কমিশনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। কিন্তু গণমনে নাভিশ্বাস। কমিশনের মানসিকতায় তাদের আস্তা নেই। ভাবছে হয়তো বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখবে কমিশন, যাতে পিটিআই সরকার গঠনে অপারগ হয়।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিষয়টি শেষমেশ আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে উঠবে। ততদিনে সিন্ধু নদে অনেক পানি গড়িয়ে যাবে। পিটিআই নতুন কোনো ‘বেদের আঠাই’ আটকে যাবে কি না কে জানে!
যা হোক, কেসগুলো প্রয়োজনে আদালতে শোনা যাবে, বিচারকদের অভিমত। এটা ঠিক যে, আদালত ইদানীং যে ব্রেক লাগিয়েছে, তাতে তড়িঘড়ি সরকার গঠনের তোড়জোড়ে ধাক্কা অবশ্যই লেগেছে।
ইতোমধ্যে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগ (নওয়াজ) ক্ষমতার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে বৈঠকে বসেছে। কিন্তু সিদ্ধান্তে যথেষ্ট জটিলতা দেখা গেছে। কারণ, উভয় দলের লোলুপ দৃষ্টি সরকারপ্রধান পদটির ওপর। আশঙ্কা করা হচ্ছিল ‘খাকি’দের হস্তক্ষেপে হয়তো বিষয়টির সুরাহা হতে পারে। কারও কারও মতে তেমনটিই ঘটেছে। ক্ষমতা বণ্টনের নতুন নীলনকশা তৈরি হয়েছে।
ক্ষমতার প্রাথমিক তিন বছরে নওয়াজ শরিফ কোনো সরকার গঠন করবে এবং পরবর্তী দুবছরে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি পদনশীল হবে। পিপলস পার্টির হাতে থাকবে প্রেসিডেন্ট পদসহ স্পিকারের পদটি। পাঞ্জাব গভর্নমেন্টের শীর্ষে বসবে নওয়াজ দুহিতা মরিয়ম নওয়াজ।
অন্যদিকে পিটিআই, জামায়াত জোট তৈরির বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। পরিষদের নারী আসন ও সংখ্যালঘু আসনের সিংহভাগ লুফে নিতে জোট তৈরি বৈ কোনো পথ খোলা নেই। আর এভাবে কেন্দ্রে সরকার গঠনে পিটিআই-এর পথ সুগম হবে। রাজনীতির এ দাবা খেলা বড় জটিল। তাতে কে হারে কে জেতে কে জানে?
এইতো গেল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ টালমাটালের নীলনকশা। এর সঙ্গে বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপের বিষয়টিও জড়িত রয়েছে।
ইতোমধ্যে দেশের সীমানা পেরিয়ে দূরদূরান্ত থেকে ভোটাভুটির ফলাফলে আবার আলোচনার পক্ষে শোর উঠেছে। প্রতীচ্যের বিশেষ করে মার্কিনমুলুকের যেসব হর্তাকর্তার মুখে ইমরানবিরোধী স্লোগান গুঞ্জন উঠেছিল-সে সুরে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। ইউরোপ ও আমেরিকার স্বনাধন্য সংসদ-সদস্য ও আইনপ্রণেতারা নিজ নিজ সরকারকে পাকিস্তানের কলঙ্কিত অগণতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রাখতে আর্জি দিয়েছে।
সে আর্জিতে জনগণ রায় যাতে প্রাধান্য পায়, সে দিকে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে। ফলে ঘরে-বাইরে ইমরানবিরোধী চক্র এখন অনেকটা দিশেহারা। তবু তারা কিন্তু হাল ছাড়েনি।
পিটিআই সমর্থিত আজাদ সদস্যদের সামনে উৎকোচের পুঁটলি খুলে দেওয়া হয়েছে। অনেকে তাতে হাত ঢুকিয়েছে। বড় ধরনের লোভের বশে বিক্রি হতে কোনো দ্বিধা নেই তাদের।
নওয়াজ লীগ দাবি করেছে, এমন অনেকেই তাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে যোগাযোগ কায়েম করেছে। তবে এখনো জানা গেছে, তীব্র গণভর্ৎসনার মুখে এমনই অন্তত একজন বিকৃত সমর্থন ফিরিয়ে নিয়েছে। এদিকে দুই ভুঁইফোঁড় আর্মি সমর্থনে নতুন দল কায়েম করেও ভোটে হেরে গেছে।
তারা হচ্ছে জাহাঙ্গীর তরিন ও পারভেজ খটক। শেষমেশ তারা নিজ দল থেকে ইস্তফা দিয়েছে। নির্দিষ্ট কারণ অবশ্য জানা যায়নি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামের করাচির আমির হাফিজ নঈম কারচুপি ভোটের মাধ্যমে জিতিয়ে দেওয়ার বিষয়ে বিরূপ মনোভাব পোষণ করতঃ প্রলুব্ধ আসন নিতে রাজি হয়নি। বলেছে এটি পিটিআই প্রার্থীর পাওনা। নঈমের এমন উক্তি ভোট কারচুপির পর্দা উন্মোচনে সহায়ক হয়েছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন।