রাসুল (সা.) যে কারণে শাবান মাসে বেশি রোজা রাখতেন
মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান
দিন-রাতের আবর্তন হলো আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি রহস্যের অনুপম নিদর্শন। এই আবর্তনের মাধ্যমে মানুষ সময়ের হিসাব নির্ধারণ করে। সময় পরিক্রমায় সাত দিনে এক সপ্তাহ, ৩০ দিনে এক মাস এবং ১২ মাসে এক বছর গণনা কর হয়। এই বিভাজিত সময়ের মধ্যে মহান আল্লাহ বিশেষ বিশেষ কিছু সময়ে বিভিন্ন ধরনের ইবাদত নির্ধারণ করেছেন।
যেমন—দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ। শুক্রবার দিন জুমা ফরজ। বছরে এক মাস রোজা ফরজ। ফরজের পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ সময়ে কিছু নফল ইবাদত আছে, যা পালন করলে এর প্রতিদান অন্য সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে যায়।
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও পুরস্কারপ্রাপ্তির সময়গুলো বারবার আমাদের সামনে ঘুরে-ফিরে আসে। বুদ্ধিমান মুমিন এই সময়গুলোকে কাজে লাগায়। শাবান মাস এ ধরনের নফল ইবাদতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। শাবান মাসের আগমনে মুসলিম হৃদয়ে আনন্দ ও খুশির অনুভূতি তৈরি হয়।
কেননা শাবান মাসের পরই আগমন ঘটে মুমিনের অত্যন্ত প্রিয় পবিত্র রমজান মাসের। এ মাস থেকেই চরম উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে মুসলমানরা রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে।
১. শাবান মাসের নামকরণ
চান্দ্র মাসের অষ্টম মাসের নাম হলো শাবান। এর বহুবচন হলো শাবানাত। এর দুটি অর্থ হতে পারে।
একটি হলো বিভক্ত হওয়া বা বিচ্ছিন্ন হওয়া। অপরটি হলো শাখা-প্রশাখা। রজব মাসের পর আরবের লোকেরা পৃথক হয়ে যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে যেত বলে এই মাসের নাম শাবান।
আবার কারো মতে, আরবের লোকেরা পানি অনুসন্ধানের জন্য বিভক্ত হয়ে বের হতো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত বলে একে শাবান বলা হয়। শাবান হলো রজব ও রমজানের মাঝামাঝি এবং উভয় মাসের পার্থক্যকারী। আনাস (রা.) বলেন, এই মাসের নাম শাবান রাখার কারণ হলো এই মাসে রোজা পালনকারীরা শাখা-প্রশাখার মতো বেশি বেশি সওয়াবপ্রাপ্ত হয়। (মা সাবাতা বিস সুন্নাহ : ১৮৮)
২. বেশি বেশি নফল রোজা পালন করা
শাবান মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বেশির ভাগ দিনে রোজা পালন করতেন। উসামা বিন জায়েদ (রা.) বলেন, আমি প্রিয় রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছি, হে আল্লাহর রাসুল, শাবান মাসে আপনি যেভাবে রোজা রাখেন, সেভাবে অন্য কোনো মাসে রোজা রাখতে আপনাকে দেখিনি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, রমজান ও রজবের মধ্যবর্তী এই মাসের ব্যাপারে মানুষ উদাসীন থাকে। এটা এমন এক মাস, যে মাসে বান্দার আমলকে বিশ্বজগতের রব আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আমি চাই, আল্লাহর কাছে আমার আমল এমন অবস্থায় পেশ করা হোক, যখন আমি রোজাদার। (নাসাঈ, হাদিস : ২৩৫৭)
আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে এ মাসের তুলনায় অন্য কোনো মাসে এত বেশি রোজা রাখতে দেখিনি। এমনকি রাসুলুল্লাহ (সা.) কয়েকটি দিন ছাড়া প্রায় পুরো শাবান মাসই রোজা পালন করতেন। (মুসলিম : ১১৫৬)
৩. বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়
সাধারণত বান্দার আমল আল্লাহর কাছে তিনভাবে উপস্থাপন করা হয়। প্রথমত, প্রতিদিনকার আমল প্রতিদিন; দ্বিতীয়ত, প্রতি সপ্তাহে এবং তৃতীয়ত, বৎসরে একবার আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। দৈনিক আমল প্রতিদিন ফজর ও আসরের নামাজের সময় আল্লাহর কাছে বান্দার আমল পেশ করা হয়। ওই সময়ে ফেরেশতাদের দায়িত্ব পরিবর্তন হয়। সাপ্তাহিক বলতে প্রতি বৃহস্পতিবার আল্লাহর কাছে বান্দার আমল পেশ করা হয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি প্রিয় রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, প্রতি বৃহস্পতিবার জুমার রাতে বনি আদমের আমল আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। কিন্তু আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এমন ব্যক্তির আমল কবুল হয় না। (মুসনাদে আহমদ)
৪. বেশি বেশি দান সাদকা করা
আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, প্রিয় নবীজির সাহাবায়ে কেরাম শাবান মাসের চাঁদ দেখলে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াতে মশগুল হয়ে পড়তেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যাঁদের ওপর জাকাত ফরজ হয়েছে, তাঁরা মালের জাকাত আদায় করে দিতেন। যাতে গরিব ও অসহায় মুসলমানদের রোজা রাখার ব্যবস্থা হয়ে যায়। বিচারকরা কয়েদিদের ডেকে শাস্তির হকদার হলে শাস্তি দিতেন, না হয় মুক্তি দিয়ে দিতেন। (লাতায়েফুল মায়ারেফ : ১/২২১)
৫. শাবান মাসের মধ্য রজনীতে গুনাহ মাফের সুসংবাদ
শাবানের মধ্য রজনীকে বলা হয় ‘লাইলাতুল বরাত’ বা ভাগ্য রজনী। এটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি রাত। এ রাতে আল্লাহ তাআলা বান্দার পাপরাজি ক্ষমা করে দেন, দুনিয়া ও আখিরাতের নিয়ামত দিয়ে ধন্য করেন। মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে মাফ করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৫৬৬৫)
৬. রমজানের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করা
প্রিয় নবীজি (সা.) পবিত্র রজব ও শাবানে রমজানের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। এবং মানসিকভাবে তৈরি হতেন। এ কারণেই তিনি পবিত্র শাবানের দিন ও তারিখ গুরুত্ব সহকারে হিসাব রাখতেন। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসের তারিখ এতটাই মনে রাখতেন, যতটা অন্য মাসের তারিখ মনে রাখতেন না। শাবানের ২৯ তারিখ চাঁদ দেখা গেলে পরের দিন রমজানের রোজা রাখতেন। আর সেই দিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে শাবান ৩০তম দিন পূর্ণ করে রমজানের রোজা শুরু করতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৩২৭)
সুতরাং পবিত্র শাবান মাসের দিন-তারিখের হিসাব রাখাটা প্রিয় নবীজির সুন্নত এবং মুমিনের জন্য কল্যাণকর।
৭. আগের কাজা রোজা আদায় করা
ইসলামী শরিয়তের বিধানের আলোকে বিগত রমজানের রোজা যাদের কাজা আছে, তাদের আসন্ন রমজান শুরু হওয়ার আগেই কাজাগুলো আদায় করে দিতে হবে। কেননা শরিয়তসম্মত ওজর বা বৈধ কারণ ছাড়া কাজা রোজা আদায়ে বিলম্ব করা উচিত নয়। আয়েশা (রা.) বলেন, আমার ওপর রমজানের যেসব কাজা রোজা থাকত, সেগুলো শাবান মাসের ভেতরে আদায় করে ফেলতাম। (মুসলিম, হাদিস : ১১৪৬)
৮. শাবান মাসে রমজানের প্রস্তুতি
রমজানের রোজা যেহেতু বছরে একবার আসে সেহেতু তার বিধি-বিধানগুলো অনেকের কাছে স্মরণ নাও থাকতে পারে। তাই শাবান মাসে আমাদের করণীয় হলো, রমজানের বিধি-বিধান জেনে নেওয়া। যাতে রমজানের নিয়ামত আমাদের হাতছাড়া হয়ে না যায়। শাবান মাসে বেশি বেশি নফল নামাজ, তাওবা, ইস্তিগফার, কোরআন তিলাওয়াত ও জিকিরে নিয়োজিত থাকা উত্তম। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনের উচিত শাবান মাসকে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করা এবং রমজানের পরিপূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা)