ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের ভাগ্যে কী আছে?
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পট পরিবর্তনের পর সরকার সমর্থিত জনপ্রতিনিধিরা আত্মগোপনে কিংবা পরিষদে না যাওয়ায় নাগরিক সেবা ব্যাহতের কারণে এমন সিদ্ধান্ত বলেও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
স্থানীয় সরকারের ওই চারটি প্রতিষ্ঠানের পদ থেকে মেয়র চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হলেও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ক্ষেত্রে ভিন্ন নীতি সরকারের।
দেশের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই আত্মগোপনে আছেন। কোথাও কোথাও চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
এমন অবস্থায় সোমবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেছেন, “ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যানদের এখনই অপসারণ করা হচ্ছে না”।
এক্ষেত্রে যে সব জায়গায় চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত রয়েছেন সেখানে কাজ চালিয়ে নিতে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালন করতে পরিপত্র জারি করেছে সরকার।
এমন অবস্থায় কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছে সারাদেশের বিভিন্ন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও জনপ্রতিনিধিরা।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের গড়াই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বলেন, “আমি এলাকায় আছি, পরিষদেও যাই। যদি সরকার চায় পদে থাকবো, না চাইলে সরে যাবো”।
আত্মগোপনে অনেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান
গত ৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত অনেকেই চলে যান আত্মগোপনে। তাদের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ অনেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও রয়েছেন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠনের পর আস্তে আস্তে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। সারাদেশে স্কুল কলেজ অফিস আদালত চালু হয়েছে।
স্থানীয় সরকারের সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন খোলা থাকলেও অনেক জায়গায়ই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পরিষদে যাচ্ছে না বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যানরা যে সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন সে সব জায়গায় তালাও ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। সোমবার নীলফামারীর ডোমার উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয় সেখানকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা।
সারাদেশের বেশ কিছু জেলায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে মিছিল কিংবা পরিষদ ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও চলছে।
আওয়ামী লীগ নেতা এমন কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদেরকে ফোনে পাওয়া যায় নি। সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, “গত বেশ কয়েক বছর ধরে এমন সব নির্বাচন হয়েছে যে নির্বাচন নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের ফলে মানুষ এখন ক্ষোভ প্রকাশ করছে। তাদের অপসারণ চাইছে”।
তবে, যে সব ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র বা অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারা নির্বাচিত হয়েছেন সে সব জায়গায় চেয়ারম্যানদের খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না।
মির্জাপুরের ভাতগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত হয়েছি। আমি কোন দলের না। আমি এলাকায় আছি, পরিষদ চালাচ্ছি”।
প্যানেল চেয়ারম্যান ও প্রশাসক বসাবে সরকার
সারাদেশে সাড়ে চার হাজারের ওপরে ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এসব ইউনিয়ন পরিষদের বেশিরভাগেই নির্বাচন হয়েছে দুই বছর আগে। ২০১৮ সালের পর স্থানীয় সরকারের সব ধরনের নির্বাচন বয়টক করে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো।
যে কারণে গত ৬ বছরে হাত গোনা কিছু ইউনিয়ন, উপজেলা বাদে বেশিরভাগেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক জোটের উপস্থিতি ছাড়াও এসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এসবের অনেকগুলো নির্বাচন নিয়ে রয়েছে অনিয়ম কারচুপির অভিযোগ।
এমন অবস্থায় সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের যে সব ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত রয়েছে সে সব জায়গায় কাজ চালাতে প্যানেল চেয়ারম্যান কিংবা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
সোমবার রাতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে অবিলম্বে এটি কার্যকরের কথা জানানো হয়।
পরিপত্রে বলা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে দেশে বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বর্তমানে ধারাবাহিকভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন। ফলে ইউনিয়ন পরিষদের জনসেবাসহ সাধারণ কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।
সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম শহীদ খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আইনেই বলা আছে চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে প্যানেল চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করবেন। কিংবা চাইলে সরকার প্রশাসক নিয়োগও করতে পারেন”।
সরকারের পরিপত্রে বলা হয়েছে, দেশের যেকোনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে জনসাধারণের সেবাকাজ বিঘ্নিত হলে সেখানে বিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসকরা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্যানেল চেয়ারম্যানদেরকে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করবেন।
আর প্যানেল চেয়ারম্যানরাও অনুপস্থিত থাকলে সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অথবা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) এসব ক্ষমতা অর্পণ করবেন।
বিবিসি বাংলার খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল অনুসরণ করুন।
ইউপি চেয়ারম্যান অপসারণের আইন কী?
স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদের আইন অনুযায়ী, পদত্যাগ করলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যপদ শূন্য হবে। এছাড়া পদত্যাগ, মৃত্যু বা অন্য কারণে চেয়ারম্যান পদ শূন্য হলে নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত প্যানেল চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করবে।
তবে শূন্য হওয়া ছাড়াও আইন অনুযায়ী ফৌজদারি মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামী বা দণ্ডিত হলে, পরিষদের স্বার্থ পরিপন্থী কাজ করলে চেয়ারম্যানদেরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করিতে পারবে সরকার।
এছাড়াও দুর্নীতি, অসদাচরণ বা নৈতিক স্খলনজনিত কোন অপরাধ কিংবা বিনা অনুমতিতে দেশত্যাগের কারণে ইউনিয়ন পরিষদ আইন অনুযায়ী তাদেরকে অপসারণ করতে পারে সরকার।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, “নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণে সবগুলো আইনই প্রায় কাছাকাছি। তবে এসব আইন দেখে সরকার তাদের অপসারণ করছে না। একটা ভিন্ন পরিস্থিতিতে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার”।
মির্জাপুরের গড়াই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান হুমায়ূন কবির বলেন, “আমি ব্যবসা করেছি। কোনদিন মানুষের ক্ষতি করি নাই। জনগণের জন্য কাজ করার পরও যদি অপসারণ করা হয় তাহলে কী ই বা করার আছে”।
ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়া অন্য সব পরিষদের সব পদ থেকে চেয়ারম্যান ও মেয়রদের সরিয়ে দেয়ার পর সোমবার সাংবাদিকরা স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা মি. আরিফ হোসেনের কাছে ইউনিয়ন পরিষদ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন।
জবাবে মি. আরিফ বলেছেন, “যাচাই-বাছাই করে দেখা যাক সেখানে কার্যক্রম কী রকম আছে, যদি পরবর্তীকালে প্রয়োজন হয় বা প্রয়োজনের তাগিদে কোনো পদক্ষেপ নিতে হয় সেটি নেওয়া হবে”।সুত্র: বিবিসি বাংলা