শিক্ষক-শিক্ষার্থী: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
দীপক রঞ্জন দাস
“শিশু হলো উদ্যানের চারাগাছ। শিক্ষক হলেন তার মালী। শিক্ষকের কাজ হলো সযত্নে চারাগাছটিকে বড় করে তোলা। শিশুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সৎ ও সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন করা শিক্ষকের কর্তব্য।
(ফ্রেডরিক ফ্রয়েবেল) চিনের প্রাচীন নেতা কনফুসিয়াস বলেছেন—“ শিক্ষক হবেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস। তিনি একজন আর্দশ শাসক”। শিক্ষা আলোকিত সমাজ বিনির্মানের হাতিয়ার। শিক্ষক হলো সুনিপুণ কারিগর। শিক্ষা ছাড়া আলোকিত মানুষ সৃষ্টি কোনভাবেই সম্ভব নয়।
একজন শিক্ষকের কিছু কাজ ও দায়বদ্ধতা আছে। এ কাজ ও দায়বদ্ধতা সহকর্মীদের কাছে, সমাজের কাছে, দেশ ও জাতির কাছে, আগামী প্রজন্মের কাছে। একজন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। শিক্ষক শুধু সফল নয়, একজন ভালো মানুষ হতে শেখান। মানবিক বিপযর্য় বা বৈশ্বিক, অর্থনৈতিক সংকটে আক্রান্ত হয়েও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিনিমমার্নে শিক্ষকরা অবিরাম ভূমিকা রেখে চলেছেন। শিক্ষক হচ্ছেন সভ্যতার ধারক—বাহক। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, তিনি মানুষ গড়ার কারিগরও।
প্রেক্ষিত: বাংলাদেশ
সমাজ ও ছাত্র/ছাত্রীদের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষা এই তিনটির সাথে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। শিক্ষকতা হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীন পেশাগুলোর একটি। তবে বর্তমান সময়ে কিছু কিছু দুর্নীতিবাজ দ্বারা এই পেশাটি কলুষিত হচ্ছে। শিক্ষকদের মূল্যবোধ নিয়েও দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। কিছু শিক্ষক বেশী আলোচিত হচ্ছেন তাদের কর্মকান্ডের জন্য। শিক্ষক সমাজ আজ প্রাইভেট—কোচিং ব্যবসাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণীর শিক্ষক দ্বারা ছাত্রীরা যৌন হয়রানীর শিকার হচ্ছে। অযোগ্য ব্যক্তিরা রাজনৈতিক পরিচয়ে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পাচ্ছেন। সৎ, ন্যায় পরায়ন ও আলোকিত ব্যাক্তিরা শিক্ষক হিসাবে মর্যাদা পাচ্ছেন না।
শিক্ষকদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে দলাদলি, গ্রুপিং—লবিং, কোন্দল, অতিমাত্রায় দলীয় রাজনীতির চর্চা ও আনুগত্য। পদ পাওয়ার লোভে শিক্ষক সমাজ আজ ছুটছেন দলীয় নেতার পিছনে। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষা ব্যবস্থাকে করছে ধ্বংস। কয়েকদিন আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষককে গেপ্তার করা হয়েছেন। যাঁরা জাতি গঠনে ভূমিকা রাখার কথা, সেই শিক্ষকরা যদি এইরকম নিকৃষ্ট কাজের সাথে জড়িত থাকেন তাহলে এর চেয়ে হতাশাব্যঞ্জক আর কী হতে পারে? কয়েকজনের জন্য এই কলংকটা পুরো শিক্ষক সমাজের উপর পড়েছে। আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশার সাথে নিজেদেরকে জড়াতে রাজি নন। সবার ইচ্ছা বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করার। আর শিক্ষকেরা নিজেদেরকে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা ব্যবসার সাথে, সম্পৃক্ত করেছেন এবং টাকা উপার্জনের বিকল্প পন্থা বের করছেন।
সাধারনভাবেই বলা যায়, আদর্শ শিক্ষক তিনিই, যিনি তার দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকবেন, নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকবেন, ছাত্রছাত্রীদের প্রতি স্নেহ ও দায়িত্বশীল হবেন, পড়ানোর পূর্বে পাঠ সম্পর্কে অবগত হবেন, পাঠ্যের বাহিরেও বিভিন্ন বিষয়ে যার পড়াশোনা থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ শিক্ষকের কাছে না পড়ানোটাই ফ্যাশন, ক্লাসে দেরি করে উপস্থিত হওয়াটা রীতি, ছাত্রছাত্রীদের থেকে দূরে থাকাটাই সার্থকতা।
শিক্ষকদের করণীয়: সমাজের প্রত্যাশা মোতাবেক একজন শিক্ষক হবেন জ্ঞানতাপস, মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যক্তিত্ববান, চৌকস, শ্রেণীকক্ষে আগ্রহী পাঠদানকারী ও জ্ঞানবিতরণে আন্তরিক। তিনি সুবিচারক, সুপরীক্ষক, শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রক, যুক্তিবাদী, গবেষক এবং উদ্ভাবকও। তিনি সঠিক পথের দিশারী, পথ প্রদর্শক। অবশ্যই সৎ ও ধার্মিক। শিক্ষক সহজ হবেন, সরল হবেন, নির্মল হবেন, হবেন অকুতোভয় সত্যবাদী। সুপ্রতিভ ব্যক্তিত্ববান, সমাজ হিতৈষী, পরোপকারী এবং আধুনিকতা মনস্ক বিচক্ষন সমাজ সংস্কারক। শিক্ষক হবেন চারিত্রিক দৃঢ়তাসম্পন্ন, পরিশ্রমী, নিরপেক্ষ, হাস্যেজ্জ্বল, সুপরামর্শক ও প্রাণবন্ত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীকে পাঠ বুঝিয়ে দিলেই শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ নয়, পাঠ্য বিষয়ের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় মূল্যেবোধের আলোকে শিক্ষার্থীর আচরন নিয়ন্ত্রন করা শিক্ষকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এ অর্থে বিদ্যালয়কে ‘সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা হয়’।
একজন শিক্ষক শুধুই শিক্ষক নন তিনি একজন প্রশিক্ষকও বটে। শিক্ষক যখন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের কোন বিষয় বুঝিয়ে দেন, বা শিখিয়ে দেন তখন তিনি শিক্ষক; যখন সৃজনশীলতা, সততা, দক্ষতা, নৈতিকতা, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম নেতৃত্ব, কষ্ট সহিষ্ণুতা, গণতন্ত্রীমনষ্কতা ও পরমতসহিষœুতা ইত্যাদি সহ শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের বিষয়গ–লো নজরদারিতে রাখেন ও নিয়ন্ত্রন করেন তখন ঐ শিক্ষকই একজন প্রশিক্ষক। এ জন্য বোধ হয় আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাাহাম লিংকন তার পুত্রের প্রধান শিক্ষকের কাছে লিখেছিলেন— ‘তাকে শেখাবেন পাচিঁট ডলার কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি উপার্জিত ডলার অধিক মূল্যবান।
আমার পুত্রের প্রতি সদয় আচরণ করবেন কিন্তু সোহাগ করবেন না, কেননা আগুনে পুড়ে ইস্পাত খাঁটিঁ হয়। আমার সন্তানের যেন অধের্য হওয়ার সাহস না থাকে’। শিক্ষক মূল্যবোধ বিনিমার্নের আদর্শ কারিগর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মূল্যবোধ চর্চার অনন্য কারখানা। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধে উজ্জীবিত করে সমাজকে করতে পারে আলোকিত ও উদ্ভাসিত। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কাজের মধ্যদিয়ে শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধের পরীক্ষা দিয়ে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় চলছে। পাশ্চাতের স্টাইলে গড়ে উঠেছে সমাজ ব্যবস্থা। নগ্নতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা, মাদক যুবসমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। মূল্যবোধের চরম সংকট মুহূর্তে দেশের শিক্ষক সমাজকে শ্রেণীকক্ষসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল্যবোধ বিকাশের জন্য সর্বাত্বক ভূমিকা রাখতে হবে। একমাত্র আদর্শ শিক্ষকই পারেন শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে সমাজে নৈতিকতার বিকাশ ঘটাতে। শিক্ষাই আলো, শিক্ষা ছাড়া সকল পথ বা মত অন্ধকার। নৈতিক শিক্ষাই জাতির একমাত্র পাথেয়। জ্ঞানতাপস ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন— ‘নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষক ও শিক্ষাই পারে একজন মানুষকে সঠিক ও সুন্দর পথ দেখাতে। এজন্যই প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে প্রকৃত খোদাভীরু, আদর্শ ও নৈতিকতাধারা শিক্ষকের বিকল্প নেই’। শিক্ষক শিক্ষার্থীর মানসিক ও শারীরিক দুঃখ, ব্যথা, প্রয়োজন ও অসহায় অবস্থার কথা আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করবেন এবং এইগুলোর উৎকর্ষ সাধনে ব্রতী হবেন এটাই স্বাভাবিক। দার্শনিক প্লেটোর মতে “শিক্ষক হবেন ভাববাদী চিন্তার প্রত্যক্ষ ফসল, শিক্ষার মাধ্যমে তিনি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করবেন। শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হলো শিক্ষকের দায়িত্ব”।
একজন শিক্ষককে মনেপ্রাণে শিক্ষক হতে হবে। যিনি তাঁর পেশাকে ভালোবাসবেন তিনি হবেন সৎ, নিষ্ঠাবান, ন্যায়পরায়ন, সংবেদনশীল ও মানবিক। তাঁকে তার দায়িত্বের কর্তব্যের প্রতি হতে হবে আন্তরিক। শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর পরম বন্ধু, উপযুক্ত পথ প্রদর্শক এবং বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ দার্শনিক। কোন কঠিন বিষয়কে সহজভাবে ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করা শিক্ষকের একটি বড় গুন। শিক্ষার্থীর উপর সাধ্যের অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না করা, শিশুকে তার ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী পাঠদান করানোসহ নিজেকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার পাশাপাশি ছাত্র/ছাত্রীদের সবার সাথে সমান আচরণ করতে হবে। একজন আদর্শ শিক্ষকই জাতির মেধা গড়ার কারিগর। তাই তাকে হতে হবে আট—দশটি মানুষের তুলনায় সেরা। একজন আদর্শ শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য হবে— ছাত্র/ছাত্রীদের যেকোন সমস্যার ভালভাবে বুঝানোর ক্ষমতা বা দক্ষতা। সব ধরনরে পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া। ছাত্র—ছাত্রীদের সত্যের পথে চালিত করা। ছাত্র—ছাত্রীদের সাথে আত্মিক বন্ধন তৈরি করা। আনন্দের সাথে পড়ানো, যাতে করে ছাত্র—ছাত্রীরা পড়ায় মনোযোগী হয়। শিক্ষাক্রম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। উপস্থাপনের দক্ষতা। পরিবর্তনশীল মনোভাব। মিষ্টভাষী ও সদালাপী হওয়া। কথায় ও কাজে, পোশাক ও রুচিতে. পেশায় ও কর্তব্য পালনে শিক্ষক হবেন আদর্শবান, ধর্মপ্রাণ, সত্যপ্রিয় অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে বন্যায় বড়লেখার দাসেরবাজার উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ২৪ জন শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই-খাতা কিনে দিয়ে তাদের পাঠদান করেন ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস। এছাড়া করোনা ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে তিনি বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
গত বছরের ১৫ জুলাই দাসেরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাসের মানবিক এসব কাজ নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর ঐ বছরের ১৬ মার্চ আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের আয়োজনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সেলেব্রিটি হলে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের মধ্যদিয়ে দাসেরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাসকে ‘প্রিয় শিক্ষক’ হিসেবে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
জেলার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান প্রধন দীপক রঞ্জন দাস জানান, তার এই অর্জনের পেছনে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অনেকের অবদান রয়েছে। তাদের সবার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানান।
লেখক-
দীপক রঞ্জন দাস
প্রধান শিক্ষক
দাসের বাজার উচ্চ বিদ্যালয়
বড়লেখা, মৌলভীবাজার।