মুক্তি পাওয়ার জন্য জাপানিরা স্বেচ্ছায় কেন কাঁদেন

দৈনিকসিলেট ডেস্ক
সারা বিশ্বে মানুষকে ভালো থাকার জন্য হাসির ক্লাস করানো হয়, আর দুঃখ পেলে বলা হয়— মেনে নাও, এগিয়ে চলো। কারণ এগিয়ে চলাই জীবন। তখন জাপানিরা বলেন, ‘তিষ্ঠ ক্ষণকাল! একটু থামো, কেঁদে নাও। তাতে মন হালকা হবে। ভালো থাকবে।’
জাপানে ‘রুই’ শব্দের অর্থ হচ্ছে— কাঁদা। ‘কাতসু’ মানে এমন কাজ বা ক্রিয়াকলাপ যাতে আত্মোন্নতি হয়। একসঙ্গে যুক্ত করলে এর অর্থ দাঁড়ায়— আত্মোন্নতির স্বার্থে কাঁদা। জাপানে এটি শুধু একটি ভাবনা নয়, ‘রুইকাতসু’ একটা আন্দোলন।
কেঁদে ভালো থাকার এই যে পদ্ধতি, তার একটি নামও দিয়েছে জাপান— ‘রুইকাতসু’। যার মূল মন্ত্র হচ্ছে— কাঁদো, কাঁদা অভ্যাস কর। তবে দুর্বলতা থেকে নয়। কষ্টকর আবেগ থেকে মুক্তির জন্য, নিজেকে আবার নতুন করে উঠিয়ে দাঁড় করানোর জন্য এবং আবেগ আর মনের ছেঁড়া তার আবার জোড়া লাগানোর জন্য।
জাপানে এটি শুধু একটি ভাবনা নয়, প্রতিমুহূর্তে ছুটে চলা দেশটায় যেখানে একটা সময় মানুষ তাদের আবেগকে প্রকাশ করতে পারছিলেন না, তাদের কাছে প্রাথমিকভাবে ‘রুইকাতসু’ ছিল একটা আন্দোলন। ২০১৩ সালে প্রথম রুইকাতসুর ভাবনা হয়, যা ক্রমে আবেগের বহিঃপ্রকাশের একখানি কার্যকরী উপায় হিসাবে গণ্য হতে শুরু করে।
জাপানে রুইকাতসুর ভাবনা যারা প্রথম এনেছিলেন, তাদের অন্যতম হিডেফুমি ইওশিডা। হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হিডেফুমি মনে করেন, কান্না মানুষের দুর্বলতা নয়; বরং কান্না মানুষের শক্তি। আবেগ প্রকাশের অত্যন্ত কার্যকরী একটি পদ্ধতি। যদি কখনো অনেকক্ষণ ধরে প্রাণভরে কেঁদে কারও মন হালকা হয়ে থাকে, তবে তিনি এর মর্ম উপলব্ধি করবেন।
হিডেফুমি ইওশিডা ওই ভাবনা থেকেই ২০১৩ সাল থেকে কান্নার কর্মশালা শুরু করেন। যারা আবেগের বহিঃপ্রকাশ করতে পারছেন না, যাদের বুকের ভেতর কষ্ট দলা পাকিয়ে আছে, কাজ করতে দিচ্ছে না, তাদের সাহায্য করার জন্য। সেই কর্মশালায় কাঁদতে শেখানো হতো। আবেগে পরিপূর্ণ কোনো সিনেমা দেখিয়ে কিংবা পুরোনো চিঠি পড়তে দিয়ে কিংবা এমন কোনো গল্প শুনিয়ে যা কানের ভেতর দিয়ে মর্মে লাগে, অংশগ্রহণকারীদের কাঁদতে সাহায্য করতেন হিডেফুমি। দেখা যেত, সত্যিই মানুষ মানসিকভাবে অনেক হালকা বোধ করে বেরিয়ে আসছেন।
সেই শুরু। নিয়ত ধাবমান সমাজে লজ্জা না পেয়ে আর পাঁচজন মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে বসে কাঁদার নিরাপদ জায়গা পেয়ে ওই পদ্ধতিকে আঁকড়ে ধরেছিলেন মানুষ। তাতে লাভও হয়েছে। মনোবিদরা বলছেন, কান্না মানুষের শরীরের নিজস্ব চাপমুক্তির পদ্ধতি। সে ব্যাপারে কোনো দ্বিধা নেই। যে কান্না আবেগ থেকে আসে, সেই চোখের পানিতে থাকে কর্টিসল নামের হরমোন, যা স্ট্রেস হরমোন নামে পরিচিত। স্ট্রেস হরমোন শরীর থেকে বেরিয়ে গেলে তা মানসিকভাবেও ভালো থাকতে সাহায্য করে।
জাপানের তোহো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাও একই কথা বলছে। সেখানে বলা হচ্ছে, নিয়মিত কাঁদলে মানসিক উদ্বেগ কমে, হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক হয়— এমনকি কাঁদলে ঘুমও ভালো হয়। কিন্তু কান্নার জন্য কর্মশালা কেন, বাড়িতে একা কাঁদলেও কি একই লাভ হবে না?
হিডেফুমি বলেন, দুটোর মধ্যে তফাৎ আছে। বাড়িতে একা কাঁদলে একাকিত্ব বোধ হবে। পাশে অনেকে থাকলে কান্নাটা একার হলেও একাকী বোধ হবে না।
রুইকাতসুর কর্মশালা প্রায়ই হয় জাপানে। শান্ত নিরিবিলি কোনো জায়গায় ঘরের মধ্যে নিভু নিভু আলোয় হাতে রুমাল নিয়ে আর পাঁচজন মানুষের সঙ্গে নিশ্চিন্তে কেঁদে আকুল হন মানুষ। কারণ সেখানে কেউ কারও দোষ-গুণ বিচার করবে না। কটাক্ষ বা করুণা করবে না। শুধুই নিজের দুঃখে কাঁদবে, ভবিষ্যতে সুখী হওয়ার জন্য।