ঈদ তো সবাইকে নিয়ে কাটানোর উৎসব
প্রতি ঈদে বাড়ি যাই। এবার যাচ্ছি না। বাড়িই এবার আমার কাছে চলে এসেছে। বিষয়টা তাহলে খোলাসা করেই বলি, আমার কাছে ঈদ মানে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো। আর সেই পরিবার বলতে মূলত মায়ের কাছে ফেরা, বোনদের কাছে ফেরা। কিন্তু এবার মা-ই চলে এসেছেন ঢাকায়। চেনা পরিবেশ ছেড়ে ঈদে সন্তানের সঙ্গে থাকবেন। শুধু কী সন্তান? তার চেয়েও বিশেষ একজন আছেন, ঈদে মাকে ঢাকায় আনতে যিনি কলকাঠি নেড়েছেন। তিনি আমাদের বাড়ির খুদে সদস্য, নবান্ন নির্ণয়। আমার ছেলে। ছোটবেলা থেকে নানা সময়ে শুনেছি, স্নেহ নিম্নগামী। এখন কথাটার অর্থ বুঝি। আগে ঈদের এক মাস বাকি থাকতেই মা প্রতিদিন একবার করে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘বাড়ি আসবি কবে?’ শেষ তিন বছর সেই প্রশ্নটা পাল্টে গেছে। তিনি এখন আমার জন্য যতটা না অপেক্ষা করেন, তার চেয়ে বেশি অপেক্ষা তাঁর নাতির জন্য।
বছরের বিভিন্ন ছুটিছাটায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এদিক–সেদিক বেড়াতে গেলেও ঈদে সোজা বাড়ির পথ ধরি। ঈদের দিন বাড়িতে শুয়েবসে কাটালেও একটা শান্তি লাগে। ভোরে মা এসে বলবেন, ‘ওঠ, নামাজে যাবি না!’ নামাজ থেকে ফেরার পর শুরু হবে, ‘আরেকটু সেমাই খাবি?’, ‘পোলাও দিয়ে ঝাল গরুর মাংসটা গরম–গরম খা’, ‘গাছের এই পেঁপেটা খা’, ‘পুকুরপাড়ের পাকা কলাটা খেয়ে দেখ’। একটু পরপর মায়ের এই খাওয়ানোর চেষ্টা দেখে হয়তো বিরক্ত হবো, বলব, ‘খাব না।’ মা ফলের প্লেটটা টেবিলে রেখে চলে যাবেন আর আমিও মুঠোফোনের পর্দায় চোখ রাখতে রাখতে প্লেটের ফলগুলো সাবাড় করে দেব। বিকেলের দিকে বোনেরা আসবে, বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে যাব, আর এসব করেই হইহই করে কেটে যাবে একটা ঈদ। আমার কাছে ঈদের দিনটি মূলত ‘আস টাইম’। মা-বাবা, ভাইবোন আর তাদের পরিবারের পুনর্মিলনী।
এই যে বড় পরিবারের সবাই একসঙ্গে হবেন, তখন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বাবা-চাচা-ফুফুদের মধ্যে ঝগড়া হবে, আবার মিলমিশও হবে। জোরে কথা বলা যেমন থাকবে, দিন শেষে ‘সরি’ বলাটাও থাকবে। ঈদের ছুটিতে আজকাল নিজের পরিবার নিয়ে অনেকে দেশ-বিদেশে ঘুরতে যান, অথচ ঈদ বছরে দুইবারই আসে। পরিবারের সঙ্গে মিলে এই দিনটা কাটালে একটা পুরো বছরের জন্য নিজেকে রিচার্জ করে নেওয়া যায়। যৌথ পরিবার ভেঙে ভেঙে এখন আমরা একক নিউক্লিয়ার পরিবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। নিজেদের মতো করে ছুটির দিনগুলো উপভোগ করতেই পারি। সেটা তো বছরের অন্য ছুটিছাটাতেও যাওয়া যায়। ঈদের দিনটা নাহয় বৃহত্তর পরিবারের সঙ্গেই কাটল। অথবা একটা ঈদে নিজের পরিবার নিয়ে কোথাও ঘুরতে গেলেন; আরেকটা ঈদ কাটালেন মা-বাবা, ভাইবোন, চাচা-চাচি আর প্রতিবেশীবেষ্টিত হয়ে। ছুটি কাটিয়ে ফেরার পর কিন্তু নিজের মনকেই প্রশ্ন করে দেখতে পারেন, কোন ছুটিটা বেশি এনার্জি দিল। দেখবেন, পরিবারেরই জয় হবে।
মের মাঝামাঝি থেকে মা রোজ ফোন করে আমার স্ত্রীকে বলতেন, ‘নবান্নকে নিয়ে একটু বাড়ি আসো। আম পেকেছে, জামরুল বতি (পরিপক্ব) হচ্ছে। ও (নবান্ন) হাত দিয়ে একটা আম পেড়ে না খেলে আমার শান্তি লাগবে না।’
মের শেষ দিকে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি গেলেন আমার স্ত্রী। উঠানের ওপরে থাকা ছোট্ট আমগাছের ডাল থেকে আম পেড়ে সে কিছুটা খেলো, বেশির ভাগটাই খেলো না। আর এতেই আমার মায়ের ঈদের আনন্দ হলো। শেষে তিনি নিজেই রওনা হলেন, এবারের ঈদটা আমাদের সঙ্গে ঢাকায় কাটাবেন। আমার ছোট বোনও ক্যাম্পাস থেকে সোজা ঢাকার বাসায় চলে এসেছে। শ্বশুর-শাশুড়িও অস্ট্রেলিয়ায় বড় মেয়ের কাছ থেকে বেড়িয়ে ঢাকায় ফিরেছেন। সব মিলিয়ে দুই পরিবারের একসঙ্গে ঈদটা এবার হয়তো মন্দ কাটবে না। কারণ, ঈদ মানে তো প্রিয়জনদের কাছে থাকা, বড় পরিবার মিলে কাছাকাছি থাকা।