পবিত্রতার মধ্যে অপবিত্রতার বসবাস
দৈনিক সিলেট ডট কম
আতিকুর রাহমান: বলতে হয়,এ লজ্জা রাখি কোথায়? মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমান দের পবিত্র ভূমিতে বিদেশি গৃহকর্মীদের ওপর যৌন নির্যাতন।ঘটনা আজকের নয়,অনেক দিনের,অন্তত কয়েক দশক আগেকার।কয়েকটি ঘটনার সুবাদে রাষ্ট্র্রিক পর্যায়ে হস্তক্ষেপ চেয়ে গোটা দুই নিবন্ধ লিখেছিলাম দৈনিকের উপসম্পাদকীয় পাতায়।বিশেষত যাতে সৌদি আরব,কুয়েত প্রভৃতি দেশে নারী শ্রমিক পাঠানো নিষিদ্ধ করা হয়। কোনো দিকেই কিছু হয়নি।না বন্ধ হয়েছে অসহায় বাংলাদেশি নারীর ওপর যৌন নির্যাতন,না বাংলাদেশের তরফ থেকে নেওয়া হয়েছে কোনো ব্যবস্থা।যেন এরা সব গনিমতের সম্পত্তি।আর বলিহারি বাংলাদেশি নারীদের।ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরও অর্থ উপার্জনের টানে তাদের মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রা বন্ধ হয়নি।এই তো কয়েক দিন আগে রাজধানী ঢাকায় এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দেখা গেল কয়েক শ বাংলাদেশি নারীর ভিড়।প্রয়োজনীয় পরীক্ষাদির জন্য।বিদেশযাত্রায় যা আবশ্যিক।বোরকা-হিজাব সব ঠিকঠাক আছে,যার মর্যাদা দেশ বিশেষে লুণ্ঠিত।এর মধ্যে সৌদি আরবে গত বছর থেকে নারী কর্মীরা যাচ্ছেন।আর সেখানেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের অভিযোগ।২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠানোর যে চুক্তি হয়েছিল,তাতে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে সেটি হচ্ছে না।এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন,ঘটনাগুলো দুঃখজনক।আমরা যখনই এই ধরনের অভিযোগ পাই,তাঁদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করি।অন্তত ১০০ মেয়েকে আমরা ফিরিয়ে এনেছি।সচিবের নেতৃত্বে আমাদের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল সৌদি আরব ঘুরে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে এসেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে নির্মম নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশি মেয়েরা অতিরিক্ত কাজের চাপ ও নির্যাতন সামলাতে না পেরে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে দূতাবাসের সেফ হাউসে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ১৫০ জন।তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০০ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।গত তিন মাসেই ৩৫ নারীর স্বজনেরা তাঁদের ফিরিয়ে আনার জন্য আবেদন করেছেন।সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত,জর্ডান,লেবানন, ওমান ও কাতারেও গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া নারীরা শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।এক বছরে আড়াই শরও বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে এসব দেশে।এর মধ্যে সৌদি আরবের ৬০ জন, লেবাননের ৪৩ জন, জর্ডানের ৪৪ জন,দুবাইয়ের ৩৩ জন, আবুধাবির ১০ জন, ওমানের ১৪ জন ও কাতারের ১০ জনের স্বজনেরা তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য মন্ত্রণালয় ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে চিঠি দিয়েছেন।তাঁদের মধ্যে ১০০ জনেরও বেশি দেশে ফিরেছেন।সংসারে সচ্ছলতার আশায় কুড়িগ্রামের এক নারী মাস ছয়েক আগে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে যান। কিন্তু সৌদি গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার হয়ে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন।পরে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আশ্রয় নেন রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে।দুই মাস পর ৬ এপ্রিল দেশে ফিরেছেন।প্রথম আলোকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দেন এই নারী। তাঁর স্বামী ও ভাই কাঁদতে কাঁদতে প্রথম আলোকে বলেন,সবই তো শুনছেন।এখন আমরা কী করব বলে দেন।সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে গত এক বছরে এমন দেড় শতাধিক নারী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে।সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়,ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড এবংনির্যাতিত ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজনেরা এসব তথ্য দিয়েছেন।নির্যাতিত ব্যক্তিদের কাউকে কাউকে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে।জীবন বাঁচাতে ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের পূর্বোক্ত কয়েকটি দেশে যৌন অনাচার এত বেশি যে তা চোখে না পড়ে পারে না।তবু ওই যে আগে বলেছি,পবিত্র ভূমি বলে কথা।সেখানে কোনো অনাচার ঘটতে পারে না।আর ঘটলেও তাতে বোধ হয় দোষ নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো,এ-জাতীয় যৌন অনাচার বা নির্যাতন ঘটছে বিদেশিদের ওপর, নিম্নবর্গীয় নারীদের ওপর, যাদের প্রতিবাদের কোনো সুযোগ নেই বা প্রতিবাদ করলেও তা শোনার মতো কেউ নেই তাদের দেশে বা বিদেশে।তাই অত্যাচারিত হয়েও ওই সব অসহায় নারীকে মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয় অথবা চেষ্টা-চরিত্র করে স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসতে হয় জীবনের সচ্ছলতার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে।কারণ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে কোনো সুবিচার মেলে না।বরং অভিযোগের দায়ে অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়ে।তাই সহ্য করার কোনো বিকল্প পথ খোলা থাকে না।এ ছাড়া সিরিয়ায় অবৈধভাবে পাচার হওয়া বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নারী যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।তাঁদের কেউ কেউ পরিবারের উদ্যোগে দেশে ফিরতে পেরেছেন।এ নিয়ে তাঁদের পরিবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেছে।গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানোর চুক্তি হয়।সে বছর ২০ হাজার ৯৫২ জন নারী দেশটিতে গিয়েছেন।আর এ বছরের প্রথম তিন মাসেই গেছেন ২০ হাজার ৩৬ জন।এ ছাড়া গত তিন বছরে ৬০ হাজার নারীকর্মী জর্ডানে, ৫০ হাজার নারী আরব আমিরাতে, ৪০ হাজার নারী লেবানন, ৩০ হাজার নারী ওমান ও ১৭ হাজার নারী কাতারে গেছেন।মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী নির্যাতন নতুন কিছু নয়।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা অনেক দিন ধরেই বিষয়টি তুলে ধরছে।নির্যাতনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া ফিলিপাইন,ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ।কিন্তু বাংলাদেশ দুই-তিন বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে বিপুলসংখ্যক গৃহকর্মী পাঠাচ্ছে।মানিকগঞ্জের পূর্ব আওরাঙ্গবাদ গ্রামের এক নারী সৌদি আরবের বনি ইয়াসার এলাকায় কাজ করতেন।নির্যাতনের কারণে গত ১৭ মার্চ চারতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে এখন তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে।গত বছরের ১১ নভেম্বর সৌদি আরবে যান কুমিল্লার এক নারী।তাঁকে নির্যাতন করে মাথা ফাটিয়ে দিলে ১৪টি সেলাই লাগে।ধর্ষণ,যৌন নিপীড়ন:সৌদি আরব থেকে ফেরা তিনজন নারী যৌন নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।যশোরের এক নারী বলেন,গত বছরের ৫ নভেম্বর তাঁকে সৌদি আরবে পাঠায় ফাতেমা ওভারসিজ।যে বাসায় কাজ করতেন, সেই বাসার গৃহকর্তা,তাঁর ছেলে এবংছেলের বন্ধুরা তাঁকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করেছে।ঢাকার শাহবাগ এলাকার এক লোক অভিযোগ করেছেন,তাঁর স্ত্রীকে সৌদি আরবে একটি কক্ষে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে।কেরানীগঞ্জের এক নারীর স্বামী অভিযোগ করেছেন,তাঁর স্ত্রীকে যৌনকাজের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে।কুমিল্লার একজন জানান,তাঁর স্ত্রী নির্যাতন সইতে না পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে সৌদি নিয়োগকর্তার কাছে যান।কিন্তু নিয়োগকর্তা তাঁকে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছেন না।
সৌদি দূতাবাসের বিভিন্ন চিঠিতেও এই চিত্র উঠে এসেছে। গত ৪ নভেম্বর প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক চিঠিতে সৌদি রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ লেখেন,এ পর্যন্ত ৫৫ জন গৃহকর্মী অতিরিক্ত কাজের চাপ,দুর্ব্যবহার বা নির্যাতনের কারণে গৃহকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছে।প্রতিদিনই তিন-চারজন গৃহকর্মী এভাবে আশ্রয় নিচ্ছে।’ গত অক্টোবরে পাঠানো আরেক চিঠিতে তিনি লেখেন,গৃহকর্মীদের মধ্যে ৫৬ জন দূতাবাসের সহায়তায় এবং ৫৫ জনকে রিয়াদের দুটি কোম্পানির সহায়তায় দেশে পাঠানো হয়েছে। যাঁরা আসছেন,তাঁদের অনেকেরই শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নেই।
জর্ডান,লেবানন,ওমান,কাতার,দুবাই ও আবুধাবিতে এমন শতাধিক নির্যাতনের অভিযোগ প্রথম আলোর কাছে রয়েছে।ওমানের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ৬ মার্চ সরকারকে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে,ইন্দোনেশি য়াসহ অনেক দেশ ওমানে নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিলেও বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী আসছে,যাদের অনেকেই নির্যাতনের শিকার।অনেকে পতিতাবৃত্তিতে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে।এসব কারণে ভবিষ্যতে দূতাবাসের ভাবমূর্তি সংকটে পড়তে পারে।এ ব্যাপারে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস কূটনৈতিক মিশনগুলোকেও দায়িত্ব নিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।বর্তমান প্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট সুবিধা ব্যবহারের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া মোটেই কঠিন নয়।অর্থলালসা তথা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পিছে ছুটে নিম্নবর্গীয় বাংলাদেশি নাগরিকদের দুর্ভোগের শিকার হতে না দেওয়ার দায়দায়িত্ব সরকারের আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের।রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে,সেই সুবাদে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করতে হলে তার বিপরীতে জনস্বার্থের পক্ষে কিছু দায়িত্ব অবশ্যই সরকার তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে পালন করতে হবে।এটা রাজনীতির লেনদেনের অলিখিত নিয়ম।বাংলা দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির এসব বিধিবিধানের পথ ধরেই চলতে হবে এবংতা সুষ্ঠু নিয়মনীতির মাধ্যমে।দেশ শাসন করতে হলে দেশবাসীর ভালোমন্দের দায়ও নিতে হবে।সবশেষে একটি কথা,অবস্থাদৃষ্টে নিম্নবর্গীয় নারী শ্রমিকদের সৌদি যাত্রা নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করা হোক, যাতে অবিলম্বে এ সর্বনাশা যাত্রা বন্ধহয় এবং নারীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।