সিলেটে হাই-টেক পার্কের প্রকল্প বাতিল, ৩২৪ কোটি টাকাই জলে
দৈনিকসিলেট ডেস্ক
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের বর্ণি এলাকার বিস্তীর্ণ হাওর ভরাট করে হাই-টেক পার্ক নির্মাণের শুরুতেই আপত্তি তুলেছিলেন পরিবেশবাদীরা। কারণ ভারতের মেঘালয় থেকে জৈন্তা-গোয়াইনঘাট দিয়ে নেমে আসা ঢলের পানি দ্রুত নিষ্কাশনের পথ ছিল কোম্পানীগঞ্জের এই হাওর এলাকা। কিন্তু হাই-টেক পার্ক নির্মাণ করতে জলাভূমির বড় অংশ ভরাট করা হয়। এতে ঢলের পানির প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়। পাশাপাশি জৈন্তা-গোয়াইনঘাটে বন্যার পানি উত্তরের পরিবর্তে দক্ষিণমুখী হয়ে বাঘার হাওর হয়ে সুরমা নদী দিয়ে নিষ্কাশন হয়; যা সিলেট নগরের সাম্প্রতিক বন্যার অন্যতম কারণ।
তখন পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বলেছিলেন, উন্নয়নের নামে হাওর ও নদীবেষ্টিত অঞ্চল ভরাট করায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এমনকি ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছাপূরণের জন্য জলাভূমি ভরাট করে এই হাই-টেক পার্ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু এসব কথা উপেক্ষা করেই হাওর ভরাট করে শুরু হয় হাই-টেক পার্কের কাজ। হাওরে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে হাই-টেক পার্ক নির্মাণ করা হলেও প্রকল্পটি বাতিল হওয়ায় এখন জলেই ভেসে গেছে ৩২৪ কোটি টাকা!
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার সিলেটসহ চার জেলাকে এই আইটি প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রকল্পের জন্য ভারতের ঋণ না পাওয়া ও প্রকল্পের অগ্রগতি কম হওয়ায় এই চার জেলাকে বাদ দেওয়া হবে। কিন্তু তৎকালীন হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, ২০২৩ সালের জুন মাসে ৩২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্ক’ প্রকল্পটির পুরো কাজ শেষ হয়েছে। তাই এখন প্রশ্ন উঠেছে, যদি প্রকল্পের কাজ শেষই হয়ে থাকে তা হলে বাতিলের তালিকায় কেন এল সিলেটের হাই-টেক পার্কের নাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা জাগাতে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলে নির্মিত হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্ক’। ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সিলেটের পাথররাজ্যখ্যাত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বর্ণি এলাকায় ১৬৩ একর জায়গায় এই পার্কের নির্মাণকাজ শুরু হয়। হাই-টেক পার্কটির আইটি বিজনেস সেন্টারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক।
তৎকালীন হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, ২০২৩ সালের জুন মাসে ৩২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্ক প্রকল্পটির পুরো কাজ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে পার্কের সম্পূর্ণ ভূমি বরাদ্দ হয়ে গেছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরও ১০০ একর নতুন জমির অনুমোদনও দেওয়া হয়। এই পার্কে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সেতু। সেতু পেরোনোর পরেই ডান ও বাম দিকে নিরাপত্তাবাহিনীর জন্য নির্ধারিত জায়গা।
পার্কটিতে রয়েছে, প্রশাসনিক ভবন, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি অঙ্গন, সীমানা প্রাচীর, প্রধান ফটক, সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, আরসিসি সেতু, গ্যাস লাইন ও অভ্যন্তরীণ রাস্তা। এ ছাড়া রয়েছে ডিপটিউবওয়েল, পানি সাপ্লাই ও পানির পাম্প, বিদ্যুৎ ভবন, সাবস্টেশন ও ইলেকট্রিক লাইন। আছে ১০ এমভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন পাওয়ার সাবস্টেশন, আনসার ব্যারাক এবং কাঁটাতারের বেড়া।
হাই-টেক পার্কের প্রকল্প পরিচালক গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বলেছিলেন, ‘ইতোমধ্যে হাই-টেক পার্কের পুরো জায়গা বিনিয়োগকারীতে পরিপূর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে র্যাংগস ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড ৩২ একর জায়গা, হেলথ ল্যান্ডমার্ক হোল্ডিং লিমিটেড দেড় একর, রহমানিয়া সুপার মার্কেট ১ দশমিক ৭৫৯ একর, টুগেদার আইটি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১ একর, ইএলবি কোম্পানি ১ একর, ইনোটেক হোল্ডিং লিমিটেড ৩ দশমিক ৪২ একর, আইরিশ ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড ১ একর জমিতে বিনিয়োগ করেছে। এ ছাড়াও তৈরি করা ভবনেও বিনিয়োগ করেছে আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি। তথ্য ও প্রযুক্তি খাত বিকাশের মাধ্যমে প্রায় ৫০ হাজার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান হবে এই পার্কটিতে।’ প্রকল্প বাতিলের পর গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়ার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার অফিশিয়াল মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এদিকে জলাভূমি ভরাট করে গড়া পার্কের টাকা জলে গেল বলে মনে করছেন পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’-এর (ধরা) কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সিলেটের সদস্যসচিব আব্দুল করিম কিম। প্রকল্প বাতিলের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই হাওর ভরাট করে এই পার্ক এখানে না বানাতে বলেছিলাম। কিন্তু সরকার আমাদের মুখ বন্ধ করতে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী পরিবেশবীদদের দিয়ে এই প্রকল্প পরিকল্পনা করিয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এই প্রকল্পও থাকছে না। কিন্তু এই হাওর এলাকার বড় ক্ষতি হয়ে গেল।’
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ের বন্যার যে আগ্রাসী রূপ কোম্পানীগঞ্জ ও সিলেট নগরীর বাসিন্দারা দেখেছেন তার অন্যতম কারণ ছিল এই হাওর এলাকা ভরাট করে পানির প্রবাহ ও গতিপথ পরিবর্তন করা। তাই শুধু এই হাই-টেক পার্ক প্রকল্প বাতিল করলেই হবে না, এই প্রকল্পের ক্ষয়ক্ষতির দায়ও সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে। বিশেষ করে জলাভূমি ভরাটের পরামর্শদাতাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
তৎকালীন দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার মতামত দিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা শুনলাম সিলেটের হাই-টেক পার্কের পুরো কাজ শেষ হয়ে গেছে। পার্কের পুরো জায়গা বিনিয়োগকারীতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। তা হলে এখন কাজের অগ্রগতি নেই বলে কেন এটি বন্ধ করা হচ্ছে? আমাদের সঙ্গে আগে মিথ্যাচার করা হয়েছিল নাকি এখন মিথ্যাচার করা হচ্ছে? এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। যদি তৎকালীন সরকারে সুনাম বৃদ্ধির জন্য আগে মিথ্যাচার করা হয়ে থাকে তবে তখনকার সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’ সুত্র: খবরের কাগজ