সাগরপথে আবারও সক্রিয় মানব পাচার চক্র
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
সাগরপথে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে কক্সবাজারের শতাধিক মানব পাচার চক্র। স্থানীয়দের পাশাপাশি মানব পাচার সিন্ডিকেটে রয়েছে রোহিঙ্গারাও। এসব চক্রের মূল টার্গেট রোহিঙ্গারা হলেও স্থানীয় নাগরিকরাও পাচারের শিকার হচ্ছেন। এদের মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, তাদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটছে। এ পর্যন্ত মানব পাচারের রুট হিসেবে জেলার ২৫টি ঘাটকে চিহ্নিত করেছে প্রশাসন।
এদিকে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অভিযানের পরও বন্ধ হয়নি মানব পাচার। মাঝেমধ্যে ধরা পড়া সিন্ডিকেট সদস্যরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আবারও মানব পাচারে জড়িয়ে পড়েন।
অন্যদিকে কক্সবাজারে মানব পাচার আইনে ৭৪১টি মামলা হলেও আজ পর্যন্ত তার একটিরও বিচার হয়নি বলে জানান আদালতসংশ্লিষ্টরা।
নোঙর নামের একটি বেসরকারি সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে কক্সবাজারের আট থানায় মানব পাচার মামলা হয়েছে ৬৩৭টি। এর মধ্যে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় ৯৭টি, রামু থানায় ২৪টি, উখিয়া থানায় ৬৮টি, টেকনাফ মডেল থানায় ২১৮টি, চকরিয়া থানায় ১৯টি, কুতুবদিয়া থানায় একটি, মহেশখালী থানায় ৩৬টি এবং পেকুয়া থানায় ৮টি মামলা হয়েছে। থানার এসব মামলা ছাড়া ট্রাইব্যুনালেও অনেক মামলা রয়েছে।
এ ছাড়া পুলিশের একটি পরিসংখ্যান বলছে, ‘২০২০ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজারে মানব পাচার আইনে মামলা হয়েছে ১০৪টি। যার মধ্যে সদর মডেল থানায় ৩৬, চকরিয়ায় ২, মহেশখালীতে ৮, রামুতে ৬, উখিয়ায় ১৮, টেকনাফ মডেল থানায় ৩১, পেকুয়া থানায় ১ ও ঈদগাঁও থানায় ২টি মামলা হয়েছে।
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে মানব পাচার আইনে ২০১২ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৪১টি মামলা হয়েছে। তবে বিচারক সংকট ও সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে এসব মামলার একটিরও বিচার শেষ হয়নি। অনেক মামলায় আদালত আসামিদের সম্পদ ক্রোকের আদেশ দিলেও তার কোনোটি এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। এদিকে চাপ বাড়িয়েছে দেশের চলমান নতুন সংকট। অন্যদিকে মামলার দীর্ঘ সূত্রতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মানব পাচারের শিকার মানুষজন।
মানব পাচারের ২৫ রুট
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের দেওয়া তথ্যমতে, মানব পাচারের জেলার ২৫টি রুট ব্যবহার করা হচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার সদর উজেলার ঈদগাঁও, খুরুশকুল ও জেলা শহরের নুনিয়াছটা, ফিশারিঘাট, নাজিরাটেক, সমিতিপাড়া। এ ছাড়া মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, কুতুবজোম, ধলঘাটা; উখিয়া উপজেলার সোনারপাড়া, রেজুরখাল, ইনানী, ছেপটখালী, মনখালী; টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া, নোয়াখালীপাড়া, মহেশখালীয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, হাদুরছড়া, জাহাজপুরা, কচ্ছপিয়া ও শামলাপুর।
পাচার সিন্ডিকেটের সদস্যদের কয়েকজন হলেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নতুন পল্লানপাড়ার মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ ও উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের নাজির হোসেনের ছেলে জিয়াবুল হক। তাদের গত বছর র্যাব-১৫ গ্রেপ্তার করেছিল। পরে তারা জামিনে বের হয়ে আবার একই কাজে জড়িয়ে পড়েন। আরিফের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দুটিসহ চারটি মামলা রয়েছে। অন্যদিকে উখিয়ার জিয়াবুল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসাজশে অপহরণ, মুক্তিপণ ও মানব পাচারের একটি সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে থাকেন বলে জানা গেছে। তার বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া চক্রের সঙ্গে জড়িত মো. হোছন প্রকাশ মাছন মাঝি, মো. হাছন প্রকাশ আতুরী, সুলতান মাহমুদউল্লাহ, রশিদ মিয়া মেম্বার, আবদুল আমিন। এই সিন্ডিকেট সদস্যরা পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে মানব পাচার ও অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি করেন। এ ছাড়া কক্সবাজারের উপকূলঘেঁষা অধিকাংশ ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারের বিরুদ্ধে মানব পাচার সিন্ডিকেটের সদস্যদের সঙ্গে গোপনে সখ্য থাকার অভিযোগ রয়েছে। মূলত তাদের ছত্রচ্ছয়ায় এসব উপকূল পাচার রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চক্রগুলো।
পাচারের শিকার উম্মে হাবিবা নামের এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, ‘৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা চুক্তিতে আমি ও আমার ছোট বোন সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ত্যাগ করি। এ জন্য দালালকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি। বাকি ৩ লাখ টাকা মালয়েশিয়া পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দালালরা আমাদের টেকনাফের একটি বাড়িতে ২ দিন আটকে রাখে। পরে আবার মালয়েশিয়ায় যাত্রার প্রস্তুতিকালে পুলিশের কাছে ধরা পড়ি।’ তার দাবি, টেননাফের বিভিন্ন বাড়িতে এবং পাহাড়ে আরও অনেক মানুষ দালালদের হাতে আটকা পড়ে আছেন।
এদিকে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম জানান, ২০১১ সাল থেকে কক্সাবাজারে মানব পাচার আইনে ৬৩৭টি মামলা হলেও তার একটির বিচারকাজও শেষ হয়নি। মামলাগুলোর কিছু কিছু চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করা হয়েছে। তবে মামলাগুলোর সাক্ষীদের আদালতে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে। তবু এসব মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা চালাচ্ছে রাষ্ট্র পক্ষ।
এরই মাঝে সরকার পরিবর্তনের কারণে বদলেছে পাবলিক প্রসিকিউটর। কক্সবাজারের নতুন পাবলিক প্রসিকিউটর মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, তিনি নতুন যুক্ত হয়েছেন। এখনো মামলার ফাইলগুলো পাননি। পর্যায়ক্রমে তিনি মানব পাচার মামলা নিয়ে উদ্যোগ নেবেন।
একই অবস্থা মানব পাচার মামলার আরেক আদালত কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাব্যুনাল-২। এখানেও নতুন পিপি নিয়োগ হয়েছেন মীর মোশাররফ হোসেন টিটু। তিনিও এখনো ফাইল না পাওয়ায় মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেননি। তবে এসব মামলার বিচারকাজ শেষ করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান তিনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘মানব পাচারে জড়িতদের মামলাগুলো পর্যবেক্ষণ করে অভিযান চালানো হবে। আমাদের সঙ্গে যৌথ বাহিনীও কাজ করছে। বিভিন্ন সময় থানা-পুলিশ মানব পাচারের শিকার নারী-পুরুষ উদ্ধার করেছে। একই সঙ্গে একাধিক দালাল ও পাচারকারী চক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ চিহ্নিত ঘাটগুলোতে তৎপরতা বাড়িয়েছে।’