৪৬৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘জামাইবরণ’ মেলা শুরু
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার কুসুম্বী ইউনিয়নের কেল্লাপোশী এলাকায় রবিবার (২৫ মে) থেকে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী কেল্লাপোশী মেলা। প্রতি বছর তিথি অনুযায়ী জ্যৈষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় রবিবার থেকে শুরু হওয়া এই মেলা এবার ৪৬৯ বছরে পা দিল। ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবারও ব্যাপক আয়োজনে এই মেলার আয়োজন করা হয়েছে।
এ মেলাকে কেন্দ্র করে জামাইরা শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসেন। তারা মেলা থেকে সবচেয়ে বড় মাছ ও খাসি কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যান। শ্বশুররা জামাইদের মোটা অঙ্কের সেলামি দিয়ে বরণ করেন। স্থানীয়রা এই মেলাকে ভালোবেসে ‘জামাইবরণ’ মেলা নামেও ডাকেন।
মেলায় বসেছে বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট। কাঠের আসবাবপত্র, মিষ্টি, ফলমূল, বড় মাছ, কুটির শিল্পসামগ্রী, রকমারি মসলা ও নানা রকমের পণ্যে ভরপুর হয়েছে মেলার মাঠ। স্থানীয় ব্যবসায়ী ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিক্রেতারা তাদের পণ্য নিয়ে মেলায় অংশ নিয়েছেন।
মেলাটি কেবল একটি কেনাবেচার কেন্দ্র নয়, বরং এটি স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। অংশগ্রহণকারীরা জানান, এই মেলা সামাজিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে এবং নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেয়। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন ও মেলা কমিটি একযোগে কাজ করছে। মেলার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে সবার সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে।
শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এসএম মঈনুদ্দিন বলেন, ‘মেলায় কোনো অশ্লীল যাত্রা, জুয়া বা অনৈতিক কার্যক্রম চলবে না। আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।’
কেল্লাপোশী মেলার পেছনে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক কাহিনি। কথিত আছে, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে এই মেলার সূচনা হয়। সেই সময় বৈরাগ নগরের বাদশা সেকেন্দারের একজন ঔরসজাত পুত্র গাজী মিয়া ও দত্তক পুত্র কালু মিয়া রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির-সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণ নগরে আসেন। সেখানে রাজমুকুটের একমাত্র কন্যা চম্পা গাজী মিয়াকে দেখে মুগ্ধ হন এবং তাদের মধ্যে প্রেম গড়ে ওঠে।
পরবর্তীতে কালু মিয়া গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার কাছে গেলে রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দি করেন। গাজী মিয়া এতে কষ্ট পেয়ে কেল্লাপোশী নামক স্থানে একটি দুর্গ নির্মাণ করে রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং ভাইকে মুক্ত করে রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। ওই দিন ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় রবিবার। সেই আনন্দঘন দিন উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী উৎসব পালিত হয়। সেই থেকেই কেল্লাপোশী দুর্গ এলাকায় মাজার গড়ে তোলা হয় এবং ঐতিহ্যবাহী মেলার সূচনা হয়।
মেলায় অংশ নেওয়া অনেকেই বলেন, কালের পরিক্রমায় এই মেলা এখন শুধু জামাইবরণ নয়, বরং এটি আমাদের ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।