ঢোলগ্রামের গল্প
ঢোলগ্রামের এক কোণে একটা বাসস্ট্যান্ড আছে। এটা সবাই দেখতে পায় না। শুধু মৃত মানুষেরাই দেখে। যারা দুর্ঘটনায় নিহত হন, তারা মৃত্যুর পর প্রথমেই ঐ স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ান। যেন তারা ভাবতে পারেন যে জীবিত আছেন। তারা অনেক বাস আসতে দেখেন, যেতে দেখেন। আসে যায় কিন্তু বাসের চাকা মাটি স্পর্শ করে না। ওদিকে ঢোলগ্রামের মহাসড়কে এক নারী বাস ধরতে গিয়ে ধাক্কায় রাস্তার পাশে ছিটকে পড়েন। তিনি চোখ মেলে দেখেন এই স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো মানুষেরা তাকে ডাকছে। তিনি তাদের কাছে যান এবং ভাবেন যে তিনি বেঁচেই আছেন। তিনি এখান থেকে আরেক বাসে উঠে বসেন। বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে তিনি নিজের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে ওঠেন, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না।
সর্পবিদ্যা
ঢোলগ্রামের আনিস মোল্লা দেশের এক নামকরা ওঝা। সাপের বিষ নামায়। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কেউ জানে না যে সেই রাতের বেলা নিজেই সাপ হয়ে দংশন করে। দিনে সে ঝাড়ফুঁক দিয়ে বিষ সারায়, আর রাতে সেই বিষ নিজেই সুযোগ বুঝে ছড়িয়ে দেয়। এক রাতে চঞ্চল নামের এক বালক আনিস মোল্লার সাপরূপ দেখে ফেলে। নিজেকে বাঁচাতে, সে বলে– ‘আমি আপনার শিষ্য হইতে চাই; আমি এই বিদ্যা শিখতে চাই।’ আনিস মোল্লা উত্তরে বলে– ‘যদি সাপ হইতে চাস, আগে মানুষ হ; আমি মানুষ হইসিলাম, তাই সাপ হতে পারসি; মানুষই একমাত্র সাপ হইতে পারে।’
সাংবাদিকের মৃত্যুর পর
ঢোলগ্রামের এক সাংবাদিকের মৃত্যুর পর মানুষেরা ভাবল– যাক বালাই গেছে, একটা ভাতের মুখ কমেছে। এ কথা ভাবতে না ভাবতেই, ঢোলগ্রাম জুড়ে হাজার হাজার লাউডস্পিকার বেজে উঠল। সেখান থেকে একটা কণ্ঠ বাজতে থাকল। বলছে– ‘আমি আছি, আমরা আছি।’ মানুষেরা ভয়ে চিৎকার করে নিজেদের কান চেপে ধরে রাখল। কিন্তু কণ্ঠটা গেঁথে গেল তাদের মস্তিষ্কের ভেতরে। তারা কিছু বলার চেষ্টা করল; কিন্তু কারোরই কণ্ঠ শোনা গেল না, কারও ঠোঁট নড়ল না, তবে সবার হাত আপনা-আপনিই উঠে গেল কপালে– মানুষেরা সবাই স্যালুট দিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।
‘বট’ গাছের শাসন
ঢোলগ্রামে একবার এক অবাক করা রাজনৈতিক পরিবর্তন এলো। মানুষদের সরিয়ে দিয়ে গাছ এবং উদ্ভিদেরা ক্ষমতার দখল নিয়ে দেশে শাসন শুরু করল। গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে গাছেরাই মানুষের হয়ে ভোট দিয়ে নির্বাচন সফল করল। সবাই খুশি; মানুষেরাও খুশি, গাছেরাও খুশি। চারদিকে শান্তি, কোথাও কোনো সংঘাত নেই, মারামারি নেই, যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব নেই, লোভ নেই, কাউকে কাজ করতে হয় না, লেখাপড়া করতে হয় না, চাকরি-বাকরি করতে হয় না, খাওয়াদাওয়া এমনি-এমনি হয়ে যায়। মানুষেরা মনে করল অবশেষে শান্তি এসেছে, ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সত্যের জয় হয়েছে। মানুষেরা যখন সুখে-শান্তিতে দিন কাটাচ্ছে, তখন প্রকাণ্ড এক বটগাছ একদিন এক ঘোষণায় জানাল যে– ‘মানুষের সংখ্যা কমে গেল, ঢোলগ্রাম বাঁচবে’। এ কথা শুনে অন্যান্য সব গাছ সমর্থন জানিয়ে ঢোলগ্রামের পাড়ার পর পাড়া দখল করে ফেলল।
লাল পুকুর
একদিন ঢোলগ্রামের ভোরের আকাশ, মাটি, ঘাস লাল বর্ণ ধারণ করে। মানুষেরা ভাবে এ সূর্যের এক খেলা। কিন্তু সূর্যটা ঢোলগ্রামের ঠিক মাঝখানে এক পুকুরে উঠছে। পুকুরটা রক্তের রং নিয়েছে। সেখান থেকেই লাল আলো বেরিয়ে দশদিক লেপে দিচ্ছে। মাছেরা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে যেন পুকুর থেকে মুক্তি চায়। এক বৃদ্ধ যোদ্ধা হাসতে হাসতে বলেন– ‘এই পুকুরেই আমাদের স্বাধীনতা ভাসছে’। মানুষেরা বিস্মিত হয়। শিশুরা জানতে চায়– ‘স্বাধীনতা কী?’ যোদ্ধা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন; তারপর বলেন– ‘যা আমরা ভুল করে পানিতে ফেলে দিয়েছি।’
মুলা দৌড়
ঢোলগ্রামের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো একবার সবাই একসাথে ঠিক করল যে শিশুদের জন্য একটা দৌড়ের রিয়েলিটি শো করবে। মুলা দৌড়– গণতন্ত্রের মুলা। সামনে কিছু ‘গণতন্ত্র’ লেখা কিছু মুলা ঝুলিয়ে শিশুদের ছেড়ে দেওয়া হবে এবং সব শিশুই যখন দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে উঠে মুলাগুলোতে কামড় দেবে, তখনই টেলিভিশনের পর্দায় লেখা ভেসে উঠবে– গণতন্ত্রের মুলা বাস্তবায়িত হয়েছে। শো শুরু হলো, শিশুরা দৌড় শুরু করল। কিন্তু পেছনে থেকে শিশুদের পিতামাতাদের মধ্যে আরেক প্রতিযোগিতা শুরু হলো। তাদের হাতে একটা করে পিস্তল। পিস্তলগুলো দিয়ে তারা শিশুদের মাথার ওপর দিয়ে মুলাগুলোর দিকে গুলি ছুড়ল– কে মুলাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে পারে। কারও নিশানাই ঠিক হলো না। গুলিগুলো সব গিয়ে লাগল সব শিশুর মাথার ঠিক পেছনে। সবার মাথা ফুটো হয়ে গেল। তখন পিতামাতারা শিশুদের বাঁচাতে, রক্ত বন্ধ করতে শিশুদের মাথার ফুটোর মধ্যে মুলাগুলো ঢুকিয়ে দিল। তখন টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠল– গণতন্ত্রের মুলা বাস্তবায়িত হয়েছে।
মব চত্বর
ঢোলগ্রামের ঠিক মধ্যিখানে প্রকাণ্ড এক চত্বর আছে। সেখানে প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে– ভিড় জমায়। কারও উচ্চ কণ্ঠ, কেউ মনের কথা বলে, কারও দৃষ্টি একটু বাঁকা– শুরু হয়ে যায় উন্মাদনা। কে কী করল, কে কী বলল, কেউ কোনো দোষ করল কিনা, কে দোষী, কেন দোষী, কে দোষী না– কেউ জানে না, জানতে চায় না। একজন তর্জনী তুললেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে আর নাচে। সবাই নাচতে চায়। লাঠি, ইট, ঘুসি-লাথি– সব মিলে এক নাচ শুরু হয়।
আকাশে তখন কাক ডাকে। অনেক আর্তনাদ মিলিয়ে যায় সেই ডাকের সঙ্গে। কয়েক মিনিটেই তাদের নাচ শেষ হয়ে যায়। কয়েকটি দেহ পড়ে থাকে। নৃত্যকারীরা সব ভুলে যে যার পথে চলে যায় যেন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু মাটিতে পড়ে থাকা রক্ত শুকায় না। আঁধার নামলে সেই রক্ত নদীর মতো বইতে শুরু করে। তখনও মানুষেরা রাস্তায় হাঁটে, বাড়ি ফেরে। তাদের পায়ে পায়ে ছিটকে ছিটকে ওঠে লাল রং। ঢোলগ্রামের সবাই বাড়ি ফিরে টিভি দেখতে দেখতে বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে যায়। ভোর হলে, সূর্য উঠলে সবাই সব ভুলে আপিসে যায়, শিশুরা ইশকুলে যায়। রাত হলে আবার সব মনে পড়ে, আসে নতুন মব, নতুন নাচ, আবার সব ভুলে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই।
স্বাধীনতার শব্দ
ঢোলগ্রাম একদিন স্বাধীন হয়। রাস্তায়-রাস্তায়, গলিতে-গলিতে স্বাধীনতার মিছিল বের হয়। মানুষের সবাই আনন্দ করতে, মুক্ত বাতাসে কণ্ঠ মেলাতে বেরিয়ে আসে। কিন্তু কারও কণ্ঠে কোনো স্লোগান শোনা যায় না। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা স্বাধীনতার শব্দ রেকর্ড করতে পারে না। মিছিলকারীরা সবাই যেন একসাথে ফিসফিস করছে। রাস্তার ধারে যারা দাঁড়িয়ে দেখছে, তারা ভাবে– এ কেমন মুক্তির উল্লাস? আবারও কান পাতে, নিবিড়ভাবে শোনার চেষ্টা করে। বুঝতে পারে, প্রতিটা ফিসফিসানি আলাদা, প্রতিটা স্বপ্ন আলাদা, একেকজনের চাওয়া আলাদা। সম্মিলিত কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই– তবু সবার ফিসফিসানি কেমন যেন একসাথে তরঙ্গায়িত হয়ে বয়ে যাচ্ছে। এটা কি মিছিলকারীদের মনের গুঞ্জন? কেউ বুঝতে পারে না। সাংবাদিক এবং দর্শক-মানুষেরা তখন গুঞ্জনটাকেই স্বাধীনতার স্লোগান বলে মেনে নেয়।