মুসলিম স্পেনে ধাতুবিদ্যার বিকাশ
মানবসভ্যতার মতো ধাতুবিদ্যার ইতিহাসও সুপ্রাচীন। মানবসভ্যতার বিকাশে ধাতুবিদ্যার অবদান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় লৌহ যুগ, তাম্র যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ ইত্যাদি নাম থেকে। পৃথিবীতে ইসলাম আগমনের বহু শতাব্দী আগেও ধাতুবিদ্যার চর্চা ছিল। ইসলাম সেই ধারাকে গতিশীল করেছে।
মুসলিম বিজ্ঞানীরা ধাতুবিদ্যায় অসামান্য সব অবদান রেখে গেছেন। বিশেষত মুসলিম স্পেন ছিল ধাতুবিদ্যার চর্চা ও উন্নয়নের অন্যতম কেন্দ্র। আনুষঙ্গিক বিদ্যা হিসেবে স্পেনে খনির খনন, ধাতু বিশুদ্ধকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, ধাতু
রূপান্তরের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগ করা ইত্যাদি জ্ঞানেরও বিকাশ ঘটে। যেমন—খনি-প্রকৌশল বিদ্যা, রসায়ন ও আগুন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিশোধন বিদ্যা।
মুসলিম স্পেনে ধাতুবিদ্যার বিকাশআইবেরীয় উপদ্বীপ (আধুনিক স্পেন ও পর্তুগাল) একটি খনিসমৃদ্ধ অঞ্চল। রোমান আমল থেকে এসব খনিজ সম্পদের খনন শুরু হয়। রোমান যুগ থেকেই স্পেনে রুপা, সোনা, লোহা, সিসা, তামা, টিন ও অন্যান্য ধাতু খনন করা হতো। মুসলিমরা ধাতুবিদ্যাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।
মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুসারে মুসলিম স্পেনের জাইন ও আলগ্রাভায় সোনা ও রুপার খনি, কর্ডোভায় লোহা ও সিসার খনি, মালাগায় রুবি এবং টোলেডো ও মুরসিয়ায় লোহার খনি ছিল। ভূগোলবিদ আল-ইদরিসি মতে, মুসলিম স্পেন ছিল পারদের একটি প্রধান উৎস।
মুসলিম বিজ্ঞানীরা খনি-প্রকৌশল বিদ্যার অংশ হিসেবে মুসলিম বিজ্ঞানীরা শিলা ছিদ্র করা, পাম্পের সাহায্যে খনি থেকে ধাতু উঠিয়ে আনা, খনির বিষাক্ত গ্যাস নিরাপদে বের করার কৌশল আবিষ্কার করেন। মুসলিম বিজ্ঞানী আল জাজারি তিন স্তরবিশিষ্ট পাম্প আবিষ্কার করেন, যা তৎকালীন মরক্কো ও স্পেনের খনিগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো।
ধাতুবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরিশোধন।
খনিতে পাওয়া ধাতুর ভেতর বিভিন্ন ধরনের মিশ্রণ থাকে, যা প্রাচীনকালে বিশেষ প্রক্রিয়ায় উত্তপ্ত করে বিক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথক করা হতো। এ ক্ষেত্রে মুসলিম বিজ্ঞানী আল বিরুনি, জাবির ইবনে হাইয়ান ও আল কিন্ডি বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁরা পরিশোধনের প্রাচীন কৌশলগুলো লিপিবদ্ধ করেন, সেগুলোর উন্নয়ন ঘটান এবং নতুন কৌশল আবিষ্কার করেন। তাঁদের আবিষ্কার আধুনিক ধাতুবিদ্যার ভিত্তি গড়ে তোলে।
মুসলিম স্পেনের টলোডোতে লোহা ও ইস্পাত উৎপাদন হতো। সে সময় স্পেনের উৎপাদিত লোহা ও ইস্পাত সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। মুসলমানরা ভারত, পারস্য ও দামেস্ক থেকে তাদের অর্জিত জ্ঞান ইস্পাতশিল্পের উন্নয়নে প্রয়োগ করেছিল। এখানে তরবারি, বর্শা, বর্মসহ বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র তৈরি হতো এবং তা সারা বিশ্বে রপ্তানি হতো। ভূগোলবিদ ইবন হাওকল লিখেছেন, টলোডো তার তরবারির জন্য দামেস্কের মতো সারা বিশ্বে পরিচিত ছিল।
ধাতুর অলংকরণেও মুসলিম স্পেনের সুনাম ছিল। এখানে তরবারি, বর্ম, ছুরি, কাঁচি অলংকৃত করা হতো। যেমন—স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া, কারুকাজ করা, ধাতুর ওপর সোনা-রুপা নকশা বসানো, তাতে রত্ন যোগ করা, মীনা করা ইত্যাদি। মুসলিম স্পেনের আলমেরিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পিতলের কাজ হতো, যেখানে তৈরি হতো মোমদানি, ধূপদানি, থালা, বাতি, চাবি ও তালা এবং অন্যান্য দৈনন্দিন ও বিলাসদ্রব্য। ইসলামী স্পেনের ধাতুকর্ম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বহু বিলাসপণ্যের চাহিদা পূরণ করত। চীনা মাটির শিল্পেগু ব্যবহৃত গ্লেজ ও কাপড়ের জন্য ফিক্সেটিভও মুসলিম স্পেনে তৈরি হতো। মুসলিম কারিগররা মৃৎশিল্প ও দস্তায়ও গ্লেজ ব্যবহার করত, যা ছিল সমগ্র ইউরোপের জন্য এক অভিনব বিষয়।
স্পেনে আমেরিকা মহাদেশের খনিজ সম্পদগুলো হাতে পাওয়ার পর মুসলিম আমলের জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়েছিল। এমনকি তারা মুসলিম কারিগরদের জোরপূর্বক অভিবাসনের মাধ্যমে আমেরিকা মহাদেশের খনিগুলোতে নিয়োগ দিয়েছিল। স্পেনের এই উদ্যোগ বিশ্ব অর্থনীতিতে গতিপথ তৈরি করেছিল। এমনকি স্পেনের মুদ্রা বিশ্ববাণিজ্যের বিনিময় মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। ইসলামিক স্পেন ডটটিভি অবলম্বনে