ঐতিহাসিক বাংলোটি সংরক্ষণ করতে চায় সরকার, আপত্তি শ্রমিকদের
বাংলোটি ঐতিহাসিক। এখানে ১৯৭১ সালে গড়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সেনা সদর দপ্তর। বাংলোটি সংরক্ষণ করতে চায় সরকার। হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা–বাগানে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বাংলোটিকে সংরক্ষণ করে জাদুঘরে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এই লক্ষ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) অধীনে থাকা বাংলোসহ সংশ্লিষ্ট জমির লিজ বাতিল করতে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
তবে চা–বাগানের শ্রমিকেরা এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। শ্রমিকদের আশঙ্কা, লিজ বাতিল হলে তাঁদের কাজ ও জীবিকা ব্যাহত হতে পারে।
দেশ স্বাধীনের পর বিভিন্ন সময় বাংলোটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলে সরকারি নথি থেকে জানা যায়। তবে তা সফল হয়নি।
এখন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলোটিকে সংরক্ষণ করে জাদুঘরে রূপ দিতে উদ্যোগী হলো।
হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তেলিয়াপাড়া চা-বাগান। জেলার মাধবপুর উপজেলার মধ্যে পড়েছে স্থানটি। গত ৭ এপ্রিল সিলেটের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি অ্যান্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সভাপতি কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুস সালাম (বীর প্রতীক) মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজমকে একটি চিঠি দেন।
চিঠিতে বলা হয়, প্রয়াত সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম) অনেকবার তেলিয়াপাড়া চা–বাগানের বাংলোকে সংরক্ষণ-রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হন। বর্তমানে বাংলোটি এনটিসির অধীনে রয়েছে। এনটিসির বেশির ভাগ মালিকানা সরকারের। বাংলোটিকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম সদর দপ্তর হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণ ও তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের মাধ্যমে একটি পরিদর্শন এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত গুরুত্বপূর্ণ স্থানটিতে জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। দর্শনার্থীরা যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারেন, সে জন্য এই পরিকল্পনা। সে ক্ষেত্রে এনটিসিকে বিকল্প স্থানে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে দেওয়া হবে।
বিষয়টি আমলে নিয়ে এনটিসিকে দেওয়া বাংলোসহ সংশ্লিষ্ট জমির লিজ বাতিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
তেলিয়াপাড়া চা-বাগান ব্যবস্থাপকের এই বাংলোতে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল বসেছিল একটি গোপন বৈঠক। বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী। তিনি ভারতের আগরতলা থেকে এসে বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন।
এরপর হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে সরকার জাদুঘর নির্মাণ করলে এনটিসির আপত্তি থাকবে না। তবে এনটিসির স্থাপনার জন্য বিকল্প স্থাপনা নির্মাণ করে দিতে হবে।
গত ১১ আগস্ট হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনকে (ডিসি) আরেকটি চিঠি দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। চিঠিতে লিজ বাতিলের অগ্রগতি জানাতে বলা হয়।
হবিগঞ্জের ডিসি মো. ফরিদুর রহমান ৩০ আগস্ট প্রথম আলোকে বলেন, তেলিয়াপাড়া চা–বাগানের বাংলোটিতে জাদুঘর নির্মাণে আপত্তি জানিয়েছেন শ্রমিকেরা। তাঁরা চান না, এখানে জাদুঘর হোক।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী বলেন, শ্রমিকেরা যে আপত্তি জানিয়েছেন, তা তাঁরা শুনেছেন। দর্শনার্থীরা সেখানে যাক, এটা শ্রমিকেরা চান না। ইতিমধ্যে চা বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে।
হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তেলিয়াপাড়া চা-বাগান। জেলার মাধবপুর উপজেলার মধ্যে পড়েছে স্থানটি।
মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত গুরুত্বপূর্ণ স্থানটিতে জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। দর্শনার্থীরা যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারেন, সে জন্য এই পরিকল্পনা। সে ক্ষেত্রে এনটিসিকে বিকল্প স্থানে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে দেওয়া হবে।
তেলিয়াপাড়া চা-বাগান ব্যবস্থাপকের এই বাংলোতে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল বসেছিল একটি গোপন বৈঠক। বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী। তিনি ভারতের আগরতলা থেকে এসে বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। পরে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন।
বৈঠকে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২৭ জন সেনা কর্মকর্তা অংশ নিয়েছিলেন। বৈঠক থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত এসেছিল। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল পুরো দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা। জেড ফোর্সসহ একাধিক ফোর্স গঠন। স্বাধীনতাযুদ্ধের নকশা প্রণয়ন। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথগ্রহণ। সম্মুখ সমরের পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ। প্রতি বছরের ৪ এপ্রিল পালিত হয় ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ১ হাজার ৫৮০ একর সরকারি জমি এনটিসির পক্ষে তেলিয়াপাড়া চা–বাগানের অনুকূলে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত রয়েছে। ২০৩৭ সাল পর্যন্ত এই জমি লিজ দেওয়া হয়েছে। চা–বাগানের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিসৌধসহ এর আশপাশের ৭ দশমিক ৬২ একর জমিতে প্রত্যক্ষভাবে চা চাষ হয় না। এই জমিতেই বাংলোটির অবস্থান।
তেলিয়াপাড়ার বাংলোটিকে সংরক্ষণ করতে হবে। নইলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মূল্যবান এই স্মৃতি হারিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে হবে।
কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুস সালাম, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি অ্যান্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সভাপতি
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, উল্লিখিত পরিমাণ ভূমির (৭ দশমিক ৬২ একর) লিজ বাতিল করা হলে তা চা–বাগানে চা উৎপাদনে ক্ষতি করবে না। তাই এই ভূমিটুকুর লিজ বাতিল চায় সরকার।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা সংরক্ষণে ২০২২ সালে এই ভূমিটুকুর লিজ বাতিল করতে ভূমি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন। যদিও তা বাতিল হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সেনা সদর দপ্তরের কথা নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে অজানা। তাই বাংলোটি সংরক্ষণের পর সেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলা হবে।
ঐতিহাসিক বৈঠক
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চা-বাগানের শ্রমিকেরা তাঁদের কাজ ও জীবিকা নিয়ে শঙ্কিত। তাই লিজ বাতিল হলে তাঁদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেই নিশ্চয়তা চান তাঁরা। বারবার উদ্যোগের পরও কেন বাংলোটিকে জাদুঘর করা যায়নি—এমন প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সেনা সদর দপ্তর গৌরবান্বিত হোক, তা চাননি রাজনীতিবিদেরা। তাঁরা হয়তো ভেবেছেন, এতে রাজনীতিবিদদের অবদান ছোট হয়ে যাবে।
জাদুঘর হওয়ার পর তা কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কেউ কেউ বলছেন, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যৌথ সমন্বয়ে একটি ট্রাস্টি করা যেতে পারে। ট্রাস্টির মাধ্যমে জাদুঘর পরিচালিত হতে পারে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মিশে আছে এই বাংলোয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধের সাক্ষী বাংলোটি। কিন্তু ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি আজও তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপকদের বাংলো হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি অ্যান্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সভাপতি কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুস সালাম বলেন, তেলিয়াপাড়ার বাংলোটিকে সংরক্ষণ করতে হবে। নইলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মূল্যবান এই স্মৃতি হারিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে হবে।