রমজানে রোজাদারকে ইফতার করানোর বিশেষ পুরস্কার

মাওলানা শামসুল হক নদভি
রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ। পবিত্র রমজানের রোজা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল পূর্ববর্তীদের জন্য। যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৩)
রোজা একই সঙ্গে আত্মশুদ্ধি ও শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার উত্তম পদ্ধতি।
এটা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে যেমন সত্য, সামাজিক ও সামগ্রিক জীবনেও তেমন সত্য। আয়াতে বর্ণিত ‘যেন তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো’ বাক্য থেকে সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়। এই উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে—সেটা হতে পারে লেনদেন, অধিকার, সম্পর্ক, আত্মীয়তা, আত্মীয়তার অধিকার, মুসলিম প্রতিবেশী, অমুসলিম প্রতিবেশী, ঘর ও পরিবারের ব্যাপারে। মুমিন বান্দা সব বিষয়ে, এমনকি শত্রুর প্রতি রাগ ও ক্ষোভের ক্ষেত্রেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করবে, তার মর্জি মতো কাজ করবে।
মুমিনের কোনো কাজই আল্লাহর ভয় ও সন্তুষ্টির চিন্তা থেকে মুক্ত হবে না। আল্লাহভীতির মূলকথা হলো আত্মিক পরিশুদ্ধি ও নৈতিক জীবনের জন্য ক্ষতিকর সব বিষয় থেকে নিজেকে দূরে রাখা। তাকওয়া অর্জনের উপকারিতা হলো পরকালীন জীবনের স্বাদ ও অনুগ্রহগুলোর মর্ম অনুধাবনের যোগ্যতা তৈরি হয়। এ জন্য হাদিসে রোজা ও রোজাদারের বহু মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে।
হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও প্রতিদানের আশায় রোজা রাখবে তার অতীতের সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০১)
অন্য হাদিসে এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্যই—রোজা ছাড়া। তা আমার জন্য, আমি নিজেই তার পুরস্কার দেবো। আর রোজাদারদের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের ঘ্রাণের চেয়ে বেশি সুগন্ধযুক্ত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯২৭)
এমন সম্মান, মর্যাদা ও প্রতিদানের ঘোষণা অন্য কোনো আমলের ব্যাপারে আসেনি। এই হাদিস থেকে আল্লাহর কাছে রোজাদারের মর্যাদার ধারণা পাওয়া যায়। রোজাদারের অনন্য মর্যাদার কারণে তাঁকে ইফতার করানোর বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে রোজাদারকে ইফতার করায় তাঁর প্রতি রাতে রহমতের ফেরেশতা প্রেরণ করা হয় এবং কদরের রাতে জিবরাইল (আ.) (কুদরতি উপায়ে) তাঁর সঙ্গে মুসাফা করেন। জিবরাইল (আ.) মুসাফা করার একটি নিদর্শন হলো তাঁর অন্তর বিগলিত হবে এবং চোখে অশ্রু আসে।
একটু ভেবে দেখুন! যে রোজাদারকে ইফতার করানো এত পুণ্যের কাজ, সেই রোজাদারকে আমরা কত কষ্ট দিই, তাদের গিবত (দোষ চর্চা) করি, তাদের কত অধিকার নষ্ট করি। রোজাদারের জন্য বর্ণিত মর্যাদা ও সম্মান থেকে প্রমাণিত রোজাদার আল্লাহর বিশেষ বান্দা। আর একজন বিশেষ বান্দার গিবত করলে, তার অধিকার হরণ করলে, তাঁকে গালমন্দ করলে, তাঁর অন্তরে কষ্ট দিলে আল্লাহ কি অসন্তুষ্ট হবেন না! আর এসব বিষয় চিন্তা-ভাবনা করি না বলেই রোজা মানুষের জীবনে যেসব পরিবর্তন আনার কথা তা হয় না।
অন্যের অধিকার হরণ, অন্যের ক্ষতি করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা, সন্তানদের দ্বিনি অধিকারগুলো আদায় করার ব্যাপারে আমরা একেবারেই উদাসীন। এর অর্থ হলো রোজার উদ্দেশ্য আল্লাহভীতি অর্জনের কোনো চিন্তা ও চেষ্টা আমাদের নেই।
রমজানে আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনাহারে থেকে, জিকির ও তিলাওয়াত করে, তারাবির নামাজ আদায় করে অন্য সব বিষয় থেকে যেভাবে উদাসীন হয়ে যাই এবং জীবনের গাড়ি পুরনো রাস্তায় চলতে থাকে, তা খুবই ভয়ের, অকৃতজ্ঞতার ও অবমূল্যায়নের। আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে আমাদের রোজার মতো নিয়ামত দান করেছেন। তার উদ্দেশ্য বলে দিয়েছেন। আর আমরা উদ্দেশ্য ভুলে কেবল অনাহারে দিন কাটিয়ে এবং সামান্য কিছু ইবাদত করে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছি। এ কারণেই আমরা এমনভাবে জীবন যাপন করি, যেন পবিত্র রমজানের বরকতের ছায়া তাতে পড়ে না।
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.) বলতেন, রমজান মাসে আমরা সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে রোজা রাখি তা ছোট রোজা। কেননা তার মেয়াদ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, রমজানের ১ তারিখ থেকে শেষ ২৯ বা ৩০ তারিখ পর্যন্ত। বড় রোজা সেটা, যেটা সাবলক হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ছোট রোজা ফরজ করা হয়েছে বড় রোজাকে বিশুদ্ধ করার জন্য। কিন্তু আমরা বড় রোজার প্রতি কতটা যত্নশীল? রোজা নষ্ট হওয়ার মতো কাজ আমরা বারবার করতে থাকি। অথচ সেটা আমাদের অনুভূতিতেই নেই। তাই আবশ্যক হলো, রমজান মাসে রোজা, তারাবি, জিকির ও তিলাওয়াতের সময় এই খেয়াল রাখা যে রোজা হলো চেষ্টা ও সাধনার মাস। তাই এমনভাবে ইবাদত-বন্দেগি করব, যেন ছোট রোজা রাখার মাধ্যমে বড় রোজার যোগ্যতা তৈরি হয়।
এমন যেন না হয় যে সারা মাস রোজা রাখার পর যখন রমজান বিদায় নেবে, তখন অনুভূতি হবে আমরা শিকল থেকে মুক্ত হলাম। সুতরাং এখন আর জায়েজ-নাজায়েজের এবং হালাল-হারামের পার্থক্য করার প্রয়োজন নেই, বরং এমনভাবে রমজান কাটাব যেন রমজানের পরও পবিত্র মাসের বরকত আমাদের ও আমাদের পরিবারের ওপর অব্যাহত থাকে, বিশেষ করে বস্তুবাদের এই যুগে বহু মানুষ উপার্জনে হালাল-হারামের পার্থক্য করে না। অথচ হারাম উপার্জন এমন বিষ, যা সব নেককাজের বরকত ও তাওফিক নষ্ট করে দেয়।
আসুন! আমরা সবাই আল্লাহর কাছে বিনীত হয়ে দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের রোজাসহ সব ইবাদত ফলপ্রসূ করেন এবং ছোট রোজা রাখার মাধ্যমে জীবনব্যাপী বড় রোজার প্রস্তুতি গ্রহণের তাওফিক দেন। আমিন।